29 C
Kolkata
Saturday, 19 July, 2025

Buy now

spot_img

অলৌকিক রহস্যে আবৃত মরুতীর্থ হিংলাজ মাতা মন্দির

ইত্থং যদা যদা বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি তদা তদাবতীর্যাহং করিষ্যাম্যরিসংক্ষয়ম্”

[এই প্রকার যখনই দানবগণের প্রাদুর্ভাব বশত বিঘ্ন উপস্থিত হবে তখনই আমি আবির্ভুত হয়ে দেব -শত্রু অসুর গণ কে বিনাশ করবো।]
{শ্রী শ্রী চন্ডী,একাদশ অধ্যায় -নারায়ণী স্তুতি,শ্লোক – ৫৪-৫৫}

সনাতন ধর্ম তথা হিন্দু ধর্মের ৫১ টি সতীপীঠের একটি অন্যতম প্রধান সতীপীঠ হলো বালুচিস্তানের মরুপ্রান্তের হিংলা নদীর তীরে হিংলাজ মন্দির। চারিদিক সুউচ্চ পাহাড়ে ঘেরা রুক্ষ মরুভুমির মাঝখান দিয়ে অমসৃণ চড়াই পথ নিয়ে চলে পাহাড়ের শেষ প্রান্তে, যেখানে জগন্ময়ী মা তার ভক্তবাঞ্ছা পূরণের উদ্যেশ্যে নিজ দেহ সম্ভূত করে জ্যোতি রূপে প্রকাশমান হয়ে আছেন। গুহার অভ্যন্তরে সদা প্রজ্জলিত অগ্নি মায়ের চিন্ময় সত্ত্বাকে যেন প্রকটিত করে রাখে। পুরান অনুযায়ী দেবী সতীকে দক্ষ যজ্ঞে হারিয়ে শিবের তান্ডব নৃত্যের পর বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র দ্বারা খণ্ডিত দেহের দেহাংশ পরে তৈরী হয় শক্তিপীঠ। এখানে মায়ের ব্রম্ভরন্ধ্র পড়েছিল। প্রত্যাক্ষদর্শীরা বলে, গুহায় বিভিন্ন ধ্বনি, দিব্য অনুভূতি, দিব্য দর্শন হয়ে থাকে। কথিত আছে, এই মন্দির স্বয়ং নাগরাজ দ্বারা রক্ষিত, দিব্য উর্জা দ্বারা পরিবেষ্টিত, অসাধু,হীন ব্যাক্তি মন্দিরের ক্ষতি করতে চাইলে সে কোনো না কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়ে থাকে। অতীতে বেলুচ-যোদ্ধা হাটু মুড়ে মন্দির পরিক্রমা করে যুদ্ধ যাত্রায় যেত। তাদের বিশ্বাস ছিল, মাতা হিংলাজ তাদের এই যুদ্ধ যাত্রাকে বিজয় প্রদান করবে। শুধু তাই নয়, দীর্ঘ পথে ক্ষুদায় তৃষ্ণায় শ্রান্ত পথচারীকে মা বালিকা রূপে বা বৃদ্ধা রূপে জল ও আহার দান করেন। সাধক পথভ্রষ্ট হলে মা তাকে পথ দেখিয়ে দেন। 

ছবিঃ মরুতীর্থ শ্রী শ্রী মা হিংলাজ মন্দির।। ফটো: হিংলাজ মাতা মন্দির অফিসিয়াল ওয়েবসাইট’র সৌজন্যে 

অবস্থান

হিংলাজ মন্দির বেলুচিস্তানের লাসবেলা জেলার মাকরণ মরুভূমির প্রায় ৬৪০০ বর্গ মিটার এলাকায়  বর্তমান। অন্যান্য দেবমূর্তির সাথে মরুভূমির প্রান্তে হিঙ্গল নদীর তীরে কির্থার পর্বতমালার শেষ প্রান্তে একটি গুহায় অবস্থিত।

পুরাণ কথা

 প্রাচীন কালে হিঙ্গলাসুর নাম এক অসুরের অত্যাচারে যখন সেখানকার জন জীবন বিপন্ন হয়েছিল,জানা যায় মাতা হিংলাজ তখন জাগরিত হয়ে হিঙ্গলাসুরকে বধ করেছিলেন। ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রী রামচন্দ্র রাবন বধ কালে তাঁর ব্রম্ভহত্যার পাপ নিবারণের জন্য মাতা হিংলাজের কাছে আসেন। কথিত আছে ব্রম্ভহত্যার পাপ থেকে মা তার আশ্রিত সন্তান কে পাপমুক্ত করেন। দ্বাপর যুগে পঞ্চ পান্ডব যুদ্ধ সমাপ্তে মাতা হিংলাজের দর্শন করে যান। বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম ক্ষত্রিয় হত্যায় উদ্দত হলে মা তাঁর সকল ক্ষত্রিয় সন্তানকে রক্ষা করেন। শিখ ধর্মগুরু গুরু নানক হিংলাজ দর্শনে এসে তাকে আধ্যাত্মিক উর্জার স্রোতস্বীনি প্রবাহ রূপে তুলনা করে গেছেন। প্রসিদ্ধ সাধক গুরু গোরক্ষনাথ এই ক্ষেত্রে এসে এর দিব্য লীলারস আস্বাদন করেছেন।

হিংলাজ মা -আদি শক্তি মহামায়া মা দুর্গার অবতার, মন্দির ও পূজা পদ্ধতি –

ছবিঃ শ্রী শ্রী মা হিংলাজ।। ফটো: হিংলাজ মাতা মন্দির অফিসিয়াল ওয়েবসাইট’র সৌজন্যে

দুর্গম পথ ,শুষ্ক আবহাওয়া, বন্য প্রাণী, ডাকাতির রোমহর্ষক বিপদ তো আছেই,কিন্তু এখানেও থেমে নেই তার যাত্রা পুরাণ। মূল মন্দির প্রবেশের দরজা হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে ৩০০ ফুট উঁচু চন্দ্রগুপ যা একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। মায়ের ভক্তরা শিবের ভৈরব রূপ হিসাবে চন্দ্রগুপ কে পুজো করার পর মনে করা হয় তার অনুমতিক্রমে পৌঁছানো যেতে পারে মায়ের কাছে। এখন থেকে পবিত্র অঘোর নদীর (পাপ বিনাশক কুন্ড) জলে স্নান করে  খালি পায়ে মূল মন্দিরের দিকে যাত্রা শুরু হয়। ভগবান গনেশ বিঘ্ননাশকারী বলে আশাপুরীধামে ভক্তরা গনেশের পূজা করেন যাতে যাত্রা সুসফল হতে পারে। গুহার নিচে রয়েছে পাথরিয়ালি মাতা ও কালী মাতা মন্দির যেখানে ভক্তরা মাতারানিদের্ আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। মূল মন্দিরে পৌঁছালে একটি ছোট গুহার ভেতর সিঁদুর লেপা প্রস্তুরখন্ডে মা স্বয়ং বিরাজ করে ভক্তবাঞ্ছা পূর্ণ করেন পূজার মাধ্যমে।

বর্তমান হিংলাজ

মহারাজ গোপাল গিরি বর্তমানে হিংলাজ মন্দিরে পূজারী। ১৯৪৫ সালে সীতাপুরে তার জন্ম। ২০০৬ থেকে তিনি মন্দিরের সেবা ভার গ্রহণ করেছেন। গুজরাটের স্বামী নারায়ণ মন্দির দ্বারা এই মন্দিরের তত্ত্বাবধান হয়ে থাকে। কিছুদিন আগে পাকিস্তান ন্যাশনাল টিভি চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মন্দির প্রসঙ্গে তিনি বলেন – বেদ ও পুরান অনুযায়ী হিংলাজ মন্দিরের অতীত ৩২ লক্ষ বছর পুরোনো। সত্য,ত্রেতা,দ্বাপর, কলি যথাক্রমে ১৭ লক্ষ ২৮ হাজার, ১২ লক্ষ ৯৬ হাজার,৮ লক্ষ ৬৪ হাজার ও ৪ লক্ষ ৩২ হাজার সময় কালের মধ্যে কলির সময় কাল সবে ৫০০০ হাজার বছর পার হয়েছে। সেক্ষেত্রে মোট কালের যোগফল থেকে মায়ের আবির্ভাব সত্য যুগের ৬লক্ষ বছর বাদ দিয়ে মন্দিরের আনুমানিক বয়স ধরা হয়ে থাকে। তিনি আরো বলেন, এখানে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায় মায়ের ভক্ত। মুসলিম সমাজ মা কে নানী মাতা বলে অভিহিত করে থাকে। প্রেম অহিংসা নিজ ধর্ম ও অন্য ধর্মের প্রতি সন্মান শান্তির মূল মন্ত্র।  এপ্রিল মে মাস নাগাদ এখানে মহান উত্তম যাত্রা শুরু হয়। মাকে চুরি ওড়না প্রদান করা হয়। কথিত আছে মায়ের কাছে ব্রম্ভ হত্যা, মিত্র হত্যা,গো হত্যা ও গুরু হত্যার পাপ বিমোচন সম্ভব হয়।    

ভারতবর্ষেও মাতা হিংলাজের পূজা করা হয়। যেমন -রাজস্থানের শ্রী মাতেশ্বরী তানোট রাই মন্দির। কথিত আছে ১৯৬৫ সালে ভারত -পাকিস্তান যুদ্ধের সময় একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে। যুদ্ধের সময় ৩০০০টি বোমা নিখ্যেপ হলেও মন্দিরটির কোনো ক্ষতি হয়নি।  

যাত্রা পথ

আকাশপথে করাচির জিন্নাহ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এ নেমে ২৮০ কিলোমিটার দূরে সড়কপথে গাড়ি করে যাওয়া যেতে পারে। সড়কপথে করাচি-কোয়েটা হাইওয়ে ধরে কোয়েটা থেকে মাকরণ হিঙ্গল জাতীয় উদ্যান।  

বেলুচিস্তান এর এই হিন্দু শক্তিপীঠ যাত্রা কষ্টসাধ্যই শুধু নয়, মরুভূমির দেশে চড়াই  উৎরাই পাহাড়ের মাঝখানে অবস্থিত এই গুহা মন্দিরে মায়ের দর্শন লাভ দেশ-কালের উর্দ্ধে কিছুটা অসম্ভাৰও বটে। পাকিস্তানের মধ্যে অবস্থিত হাওয়ায় টুরিস্ট ভিসা একমাত্র আশার আলো। তবে জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী মায়ের কাছে দেশ বিদেশ থেকে বহু ভক্ত আসবে,অনুরাগীদের ভিড় বাড়বে কারণ মা জাগৃত হয়ে উঠছেন। সময় আর ধৈর্য্য হয়তো এই আকাঙ্খার প্রতিফলন দেখাতে একদিন সমর্থ হবে।  

মন্দিরের ঠিকানা

শক্তিপীঠ শ্রী হিংলাজ মাতা মন্দির 
হিঙ্গল বালোচিস্তান ন্যাশনাল পার্ক,রোড আশা পুরা,পাকিস্তান।
ইউটউব লিংক-  https://www.youtube.com/channel/UC13xCEwXUneDL0cb8VeC7lQ

তথ্যসূত্র :

দীপান্বিতা চক্রবর্তী
দীপান্বিতা চক্রবর্তী
একাধারে সাংবাদিকতা, মানবসম্পদ ও সৃজনশীল মিডিয়ায় সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে দীপান্বিতা আজ এক বহুমুখী লেখিকা। অনলাইন প্রকাশনা, ফিচার রচনা এবং স্ক্রিপ্ট উন্নয়নের ক্ষেত্রে তার অভিজ্ঞতা তাকে তীক্ষ্ণ সম্পাদকীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং গল্প বলার এক অনন্য দক্ষতা প্রদান করেছে। গণ সংযোগ ও মানবসম্পদ উন্নয়নে স্নাতকোত্তর দীপান্বিতা ডকুমেন্টারি স্ক্রিপ্টিং, ব্র্যান্ড স্টোরিটেলিং এবং গভীর গবেষণামূলক লেখায় এক উল্লেখনীয় অবদান রেখেছেন। প্রভাবশালী ব্লগ থেকে শুরু করে আকর্ষণীয় সামাজিক মাধ্যমের কনটেন্ট, বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠকদের চাহিদা অনুযায়ী তার লেখনী শৈলী সবক্ষেত্রেই অনন্য। বিশ্ব বাংলায় তাঁর কাজ স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতির এক প্রতিফলন।

প্রাসঙ্গিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here
Captcha verification failed!
CAPTCHA user score failed. Please contact us!

সাথে থাকুন

110FansLike
105FollowersFollow
190SubscribersSubscribe
- বিজ্ঞাপন -spot_img

বাংলা ক্যালেন্ডার

সাম্প্রতিক