“বাংলাটা ঠিক আসে না…”
বাংলা ভাষা বাঙালির আত্মপরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান। শুধু ভাষা নয়—এটি আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও মানসিক গঠনের এক নিরবিচ্ছিন্ন বাহক। কিন্তু যখন একজন বাঙালি নিজের জন্মভূমি ছেড়ে প্রবাসে জীবন শুরু করেন, তখন তাঁর সন্তানদের মুখে বাংলার সুর ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসে। এই নিস্তেজতা নিছকই ভাষার বিলুপ্তি নয়—এ এক গভীর সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতার সূচনাবিন্দু।
বর্তমান প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে প্রবাসে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব সংকটের বাস্তবতা, এই সংকটের বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জসমূহ, এবং বাংলা সাহিত্যের আলোকে তার প্রতিকারের সম্ভাব্য পথনির্দেশ।

প্রবাসে বাংলা ভাষার চ্যালেঞ্জসমূহ
১. প্রাত্যহিক প্রয়োগের সংকট
প্রবাসে বাংলা ভাষা হয় দ্বিতীয় নয়তো তৃতীয় ভাষার মর্যাদা পায়। বিদেশি পরিবেশে বাংলা ভাষার দৈনন্দিন চর্চার সুযোগ কম। বাবা-মা নিজেরাই কর্মব্যস্ততার চাপে অনেক সময় ইংরেজিকেই প্রথম ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন, যাতে সন্তানদের ‘মেইনস্ট্রিম’ সংস্কৃতির সঙ্গে মেলাতে সুবিধা হয়। ফলে বাড়ির মধ্যে বাংলা ভাষার যে পরিবেশ থাকার কথা, সেটিও ভেঙে পড়ে।
২. নতুন প্রজন্মের ভাষাগত দুরত্ব
প্রবাসে জন্মগ্রহণকারী বা ছোটবেলায় বিদেশে আসা বাঙালি শিশুদের বাংলা ভাষার সঙ্গে একরকম দূরত্ব তৈরি হয়। তারা বাংলা শুনতে পারে, কিন্তু বলতে দ্বিধাবোধ করে। বাংলা লিখতে-পড়তে তো আরও দূরের কথা। অনেক সময় তারা লজ্জাবোধ করে বাংলা বলতে, কারণ বন্ধুদের মধ্যে সেটি ‘ভিন্ন’ বা ‘অপ্রচলিত’ হয়ে ওঠে।
৩. বাংলা সাহিত্যের প্রাপ্তিযোগের সীমাবদ্ধতা
প্রবাসে বাংলা বই, পত্রিকা ও সাহিত্যের সরবরাহ অপ্রতুল। বহু শহরে বাংলা বইয়ের দোকান তো দূরের কথা, পাবলিক লাইব্রেরিতেও বাংলা বই খুব কম দেখা যায়। নতুন প্রজন্মের হাতে যদি সাহিত্যের স্বাদ না পৌঁছে, তবে তারা কিভাবে ভাষার গভীরতা অনুভব করবে?
৪. প্রযুক্তি ও বিনোদনে বাংলা ভাষার অনুপস্থিতি
স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট নির্ভর এই যুগে নতুন প্রজন্মের সময় কাটে ইউটিউব, নেটফ্লিক্স বা গেমিং-এর জগতে। এই প্ল্যাটফর্মগুলো মূলত ইংরেজি বা স্থানীয় বিদেশি ভাষা-নির্ভর হওয়ায় বাংলা ভাষার উপস্থাপন সীমিত। ফলে তারা বাংলা ভাষার সঙ্গে সংযোগ হারাতে থাকে।

ভারতীয় বাংলা সাহিত্যের আলোকে বিশ্লেষণ
সাহিত্যে প্রবাসী জীবনের ভাষাগত বেদনা ও আকুলতা
বাংলা সাহিত্য বহুবার প্রবাস ও ভাষা বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা ফুটিয়ে তুলেছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম ও লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি নিচে আলোচনা করা হলো:
১. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “প্রবাসে” কবিতা
এই কবিতায় প্রবাসে বসে মাতৃভাষার প্রতি অব্যক্ত আকর্ষণ এবং এক ধরনের নিঃশব্দ বেদনার ছবি উঠে আসে:
“প্রবাসে বাংলা ভাষায় কথা বলি
যেন গোপনে চুমু খাই মায়ের মুখে।
বুকের ভেতর খেলে বেড়ায় কথারা
যারা শুধু বাংলায় হাসে, কাঁদে।”
এই কবিতা মনে করিয়ে দেয় যে ভাষা শুধুই বাহ্যিক প্রকাশ নয়—এ এক গভীর মানসিক পরিধি, যা হারালে আত্মপরিচয় হারিয়ে যায়।
২. অমিতাভ ঘোষ-এর “The Shadow Lines”
যদিও এটি ইংরেজিতে রচিত, এই উপন্যাসে বাঙালিত্ব, শেকড় বিচ্যুতি, স্মৃতি ও ভাষার পরিবর্তনের প্রসঙ্গ গুরুত্ব পেয়েছে। ভাষার মধ্যে জাতি, ইতিহাস ও ভূগোল কীভাবে মিশে যায়, তা লেখক নিপুণভাবে দেখিয়েছেন। বাংলা ভাষার প্রতি এক দ্বৈত টানাপোড়েনের চিত্র পাওয়া যায়।
৩. নির্মল বেরা সম্পাদিত “প্রবাসী বাঙালির সাহিত্য”
এই গ্রন্থে প্রবাসী লেখকদের কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধে উঠে এসেছে বিদেশে বসবাসের মধ্যে ভাষার জন্য টানাপোড়েন। অনেকেই জানিয়েছেন কিভাবে তারা সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে ভাষার সংস্পর্শে থেকেছেন।
৪. বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “অভিযাত্রিক”
যদিও এটি মূলত ভ্রমণ ও আত্মঅন্বেষণের উপন্যাস, সেখানে বিদেশে গিয়ে একাকীত্ব এবং পরিচিত ভাষার অভাবে বিভ্রান্তি যে কী গভীর হতে পারে, তা দারুণভাবে চিত্রিত হয়েছে।
সমাধান ও সুপারিশ
১. প্রবাসে বাংলা স্কুলের প্রসার
বিশ্বের অনেক শহরে এখন প্রবাসী বাঙালির উদ্যোগে বাংলা স্কুল গড়ে উঠছে। তবে এগুলোর সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার। সপ্তাহে অন্তত একদিন বাংলা শেখার ব্যবস্থা থাকলে শিশুরা ভাষার সঙ্গে বন্ধন বজায় রাখতে পারবে।
২. পরিবারে বাংলাভাষা চর্চার উৎসাহ
মা-বাবাদের উচিত বাড়িতে নিয়মিত বাংলায় কথা বলা, শিশুদের সঙ্গে বাংলা গল্প পড়া, বাংলা গান শেখানো ইত্যাদি। ‘বাংলা বলতে শেখার প্রতিযোগিতা’ বা পারিবারিক নাটক—এমন ঘরোয়া আয়োজন শিশুরা উপভোগ করে।
৩. সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে সংযুক্তি
বাংলা নাটক, কবিতা পাঠ, রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা বা শরৎ সাহিত্যচর্চার আসর—এই ধরনের অনুষ্ঠান প্রবাসে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রাণ ধরে রাখতে পারে। স্থানীয় সম্প্রদায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
৪. বাংলা প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মের প্রসার
অনলাইন পোর্টাল যেমন “StoryWeaver,” “BoiMela.in,” “RadioBanglaNet”—এই সব বাংলা প্ল্যাটফর্মের প্রচার প্রয়োজন। শিশুদের জন্য ইন্টারঅ্যাকটিভ বাংলা অ্যাপ বানানো যেতে পারে, যা তারা খেলতে খেলতে শিখবে।
৫. বাংলা লেখালেখিতে উৎসাহ প্রদান
প্রবাসী শিশু ও কিশোরদের বাংলা ভাষায় রচনা, কবিতা লেখা বা ব্লগ করার জন্য উৎসাহ দিলে তারা ভাষার প্রতি গভীরতর আগ্রহ পাবে। তাদের লেখাগুলো প্রবাসী বাংলা ম্যাগাজিনে প্রকাশের ব্যবস্থা করলে আত্মবিশ্বাসও বাড়বে।
বাংলা ভাষা শুধু একটি বর্ণমালার সমষ্টি নয়, এটি এক আত্মিক পরিচয়ের প্রতীক। প্রবাসে থেকেও কেউ যদি নিজের ভাষা ভুলে যায়, তবে সে ধীরে ধীরে নিজের শিকড় হারায়। ভাষা হারালে কেবল কথা বলার একটি মাধ্যম হারায় না, হারিয়ে যায় সংস্কৃতি, ইতিহাস ও আত্মপরিচয়।
সাহিত্য আমাদের দেখিয়েছে, ভাষার জন্য ভালোবাসা জীবনের যেকোনো প্রান্তে আমাদের সঙ্গে থাকে—শুধু প্রয়োজন মনোযোগ, চর্চা এবং সাহিত্যের অন্তঃপ্রবাহে নিজেকে সঁপে দেওয়ার। প্রবাসে বসেও বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি যদি হৃদয়ে থাকে, তবে আগামী প্রজন্ম তা ধারণ করবেই।
"ভাষা মানে মা, ভাষা মানে ঘর,
প্রবাসে গিয়েও রাখি তাকে পরিপূর্ণ অন্তর।
সাহিত্যের দীপ্ত আলো, সংস্কৃতির স্নিগ্ধ পথ,
বাংলা ভাষা বাঁচিয়ে রাখি, করিনা কোনো অসতর্ক অনুপ্রবেশ।"