ঝুলন যাত্রা।। চিত্র সূত্র: ইস্কন
ঝুলন কি ও কেন ?
উঁচু পাহাড়ের সীমানায় দাঁড়িয়ে নিচের ছবির মতো সুন্দর গ্রামের পটবিন্যাস দেখলে মনে হয় যেন রূপকথার দেশ। সেখানে সকালের আলো মাখা উজ্জ্বল ঘরগুলো যেন সাদা হলুদ নাম না জানা ফুলের মতো সাজানো। উপত্যকার বিছানো সবুজ যেন ছোট ছোট অর্ধেক ইঞ্চির এলগি বা শ্যাওলা যেখানে পরম যত্নে পাহাড়ি ক্ষেতে সবুজ রোপন করে চলেছে আঙ্গুল সমান লিলিপুটের মতো অধিবাসীরা । পাশে বয়ে চলা পাহাড়ি নদী যেন ছোট নলের ছোট জলধারা। বরফ জমানো পাহাড় যেন সাদা কার্পেটে ছড়ানো হালকা নীলের স্পর্শ। ঠিক এমন এক টুকরো ছবি প্রকৃতি থেকে তুলে এনে যদি সাজিয়ে তোলা যায়,তবে তা দেখতে পাওয়া যায় ঝুলন উৎসব এ। ঘরে বাইরে বা কোনো নিভৃত স্থানে এমনই এক টুকরো প্রকৃতি মিনিয়েচার ফ্রেম এ দেখা যায় বাংলার ঘরে ঘরে। সাথে থাকে সাতদিনের অনুষ্ঠানের প্রধান দুই চরিত্র – শ্রীকৃষ্ণ ও রাধা। আর তাদের চিরকালীন প্রেমের আতিশয্যায় দোলনায় দোদুল্যমান চির সখা ও সখি বাঁধা পরে এক সুতোর টানে যা ঝুলন যাত্রা নাম পরিচিত।

ঝুলন যাত্রা আশি নব্বইয়ের দশকেও যথেষ্ট প্রচলিত এক উৎসব ছিল। তখন ঘরে ঘরে রাধা কৃষ্ণের আবহমান কাল ধরে বয়ে চলা প্রেমরসসুধার এক প্রাণবন্ত চমৎকার আনুষ্ঠানিক প্রবাহ অনুভব করা যেত। সময়ের দ্রুত আধুনিকীকরণের সাথে সাথে হারাতে বসেছে সেই সব চোখ জুড়ানো অতীত। পরিবারের ছোট বড় সবার সাথে আকাশ পাহাড় মাঠ নদী বানানো দ্বারা যে এক জগৎ বানানো যায় আর তাতে পুরুষ ও প্রকৃতির একতার প্রতিমূর্তি কে সেই সৃষ্ট জগতের আদর্শ হিসাবে এক অপূর্ব আবহ সৃষ্টি করা যেতে পারে তা না জানা থাকলে বড় কিছু বাদ পরে যায়। জীবন মানেই যে ক্যারিয়ার আর টাকা গড়ার এক যন্ত্র নয় ,তাতে অনুভব আছে, সৃষ্টিশীলতা আছে, তার আনন্দ আছে, এ সত্য ভুলে গেলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য মুশকিল। জীবনী শক্তিকে হারাতে দিতে নেই। আর তার জন্যই উৎসব – জীবন যাত্রার এই উৎসব পালন করতে জানতে হয়।

ঝুলনে কুমোরটুলি
এই যে ঝুলন যাত্রার আবহে কুমোরটুলি সেজে ওঠে ছোট বড় হরেক রকম পুতুলের সম্ভারে,সেখানে খোঁজ করলে কিনা পাওয়া যেতে পারে। জঙ্গলের হাতি বাঘ, মাঠে বল খেলা খেলুড়ে, মাঠে চাষ করা কৃষক আর সদানন্দে নন্দিত শ্রী কৃষ্ণ রাধার যুগল মূর্তি তো আছেই। কি অসাধারণ কারিগরি দক্ষতার সাথে সৃজনশীলতা মিশিয়ে তৈরী করা হয় এমন সব ছোট ছোট পুতুল। শুধু কুমোরটুলি কেন? এই সময়ে বাজারে দোকানে অলিতে গলিতে পাশ কাটলেই চোখে পরবে এমন সব সম্ভার। বোঝা যায়, ঝুলন যাত্রার আগমন ক্ষণ। ঝুলন যাত্রার মতো উৎসব আছে বলে কুমোরটুলি আজও ধরে রেখেছে তার অস্তিত্বকে ।
অধ্যাত্ম্যিক তাৎপর্য্য
দ্বাপর যুগে বৃন্দাবনে শ্রী কৃষ্ণ রাধা ও সখি দ্বারা লীলায়তো এই উৎসব- ঝুলান উৎসব। শ্রাবন মাসের রথ যাত্রা, রাস যাত্রা, স্নান যাত্রার মতো ঝুলন যাত্রাও শ্রী কৃষ্ণের বারোটি যাত্রার মধ্যে অন্যতম। তবে, পুজো নয় বলে যাত্রা কেনো ? কারণ, পরমাত্মা শ্রী ভ্গবান স্বয়ং এই যাত্রায় তাঁর লীলায় ভক্ত হৃদয় প্রবেশ করেন। ঝুলন অর্থে দোলা। শ্রাবনের এই ঝুলন যাত্রা ভক্ত তার ইষ্টের সাথে একাত্ম হওয়ার মাধ্যম বিশেষ। তাই উৎসব পালনের মাধ্যমে প্রেম-যুগল বিগ্রহকে দোলায় ঝুলিয়ে মানসিক ভাবে ভক্ত মন এই লীলাসময়ের আধ্যাত্মিক রস আস্বাদন করেন। তাই তা কে পুজো না বলে ঝুলন যাত্রা বলা হয়।
আধ্যাত্মিক সংযোগ হলো হিন্দু ধর্মের যেকোনো উৎসবের প্রাণ বিন্দু। তা বিভিন্ন পূজার মাধ্যমে হোক বা যাত্রা বা উৎসবের মাধ্যম হোক, প্রতীকী রূপে আসল হলো ভক্ত ও পরমাত্মার একাত্মতা।
পূর্ব পশ্চিম দোলে রাধা কৃষ্ণের ঝুলন দোলা আসলে প্রকৃতি সত্বাকে দ্বৈত রূপে প্রকাশ করা। সকল শক্তির উৎস সূর্য্যকে যেমন পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে অস্ত যেতে দেখি তেমনই পূর্ব পশ্চিম দোলে সর্বশক্তি অধিকারী শ্রী ভগবানের লীলা ও শক্তিকে বোঝানো হয়।
সর্বেশ্বরবাদ -হিন্দু ধর্মের মূল তত্ত্বে সর্ব ভুতে সর্ব ক্ষেত্রে ঈশ্বর বিরাজমান। আকাশ মাটি জল আগুন উদ্ভিদ এমনকি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণের মধ্যেও শ্রী ভগবান বিরাজ করেন বলে গাছ মাটি পাহাড় ক্ষেত্ সাজিয়ে সর্বরূপে তার পূজা করা হয়। ঝুলন উৎসবে তাই প্রকৃতিকে বাস্তবায়িত করে জগৎ সাজানো হয় যার মুলে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ-রাধা,ব্রহ্ম-শক্তির অপূর্ব মিলন বা জীবাত্মা পরমাত্মায় এক হয়ে যাওয়া।
ঝুলন বাড়ি– কলকাতায় বৌবাজারে অবস্থিত রামকানাই অধিকারীর বাড়ি ঝুলন বাড়ি নাম অভিহিত। প্রায় ২০০ বছর আগে কৃষ্ণ মোহন অধিকারী নিজ গৃহে ঝুলন উৎসবের সূচনা করেন। পাঁচ দিন ব্যাপী এই উৎসবে দেবতাকে প্রথমে রাখাল বেশ তারপর যোগী বেশ,পর্যায়ক্রমে সুবল, কোটাল ও শেষে রাজ্ বেশে পুজো করা হয়। এছাড়াও খড়দহের শ্যামসুন্দর মন্দির, বিষ্ণুপুরের মদন মোহন জিউর মন্দির, বরানগর বক্শি বাড়ি বাংলার প্রখ্যাত ঝুলান যাত্রা উৎসবের প্রতীকী।
ঝুলন যাত্রা উৎসব স্থান – বৈষ্ণব পন্থী বিশ্বব্যাপী ভক্তগণের কাছে দেশে ও বিদেশে মায়াপুর ও ইস্কনের আন্তর্জাতিক কেন্দ্র গুলো ঝুলন উৎসব পালন করে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপ যা গুপ্ত বৃন্দাবন নামে পরিচিত, সেখানে গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা মহা সমারোহে এই উৎসব পালন করে থাকে।
ঝুলন যাত্রার সময় কাল ও তিথি -এবছর ২০২৫ এ ৫ই আগস্ট থেকে শুরু হয়ে ৯ আগস্ট অবধি ঝুলন যাত্রা পালিত হবে।
তথ্য সূত্র ➖
২) ইস্কন