বাংলা সাহিত্য নারী চরিত্রের বহুমাত্রিক রূপায়ণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সমৃদ্ধশীল। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যে নারীর অবস্থান, দায়িত্ব এবং ভূমিকার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
“সমাজে এক শ্রেণীর মানুষ, যাদের স্বীকৃতি কেবল বইয়ের পাতায়”
এক সময় নারীকে কেবল গৃহিণী বা পরিপূর্ণা হিসেবে চিত্রায়িত করা হলেও, আধুনিক বাংলা সাহিত্যে নারীর সামাজিক দায়িত্ব, স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত জীবন এবং সংগ্রাম গভীরভাবে ফুটে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যে প্রভাবশালী কিছু সাহিত্যিক এবং তাদের রচনা নারীর অবস্থানকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রকাশ করেছে, যা সমাজে নারীর ভূমিকা ও দায়িত্ব নিয়ে আমাদের ভাবতে বাধ্য করে।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নারীর মানসিকতা এবং তাদের অবস্থান নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন। তার বিভিন্ন কাব্য, গল্প এবং নাটকে নারীর চরিত্র বহুমাত্রিকভাবে উঠে এসেছে।
“ঘরে-বাইরে“:

এই উপন্যাসে ঠাকুর নায়িকা বিমলার চরিত্রের মাধ্যমে নারীর দ্বৈত দায়িত্বের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। বিমলা কেবল একজন গৃহিণী হিসেবে নয়, সমাজের রাজনৈতিক এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে নারীর নতুন রূপ ফুটিয়ে তোলেন। রবীন্দ্রনাথের নারীরা স্বাধীনচেতা, বুদ্ধিমতী এবং সমাজের চলমান ধারা নিয়ে সচেতন।
“চারুলতা” (নষ্টনীড় গল্প):
এই গল্পে রবীন্দ্রনাথ নারীর ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং তার মানসিক অবস্থার উপর জোর দেন। চারুলতা কেবল একটি পরিবারের গৃহিণী নয়, বরং তার ভেতরে থাকা সৃজনশীলতা এবং একাকীত্বের বেদনা নিয়েও গল্পটি আবর্তিত হয়। এ গল্প নারীর মনের ভেতরকার সংগ্রাম এবং নিজের জায়গা খোঁজার প্রতিচ্ছবি।
শরৎচন্দ্রের সাহিত্যেও নারীর প্রতি সহানুভূতি এবং তাদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে বিস্তর আলোচনা রয়েছে। তিনি নারীদের সংগ্রাম, দুর্বলতা এবং শক্তির ছবি অত্যন্ত নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন।
“দেবদাস“:
শরৎচন্দ্রের এই বিখ্যাত উপন্যাসে পার্বতীর চরিত্র একজন নারীর ভেতরের শক্তি এবং সামাজিক বাধাকে অতিক্রম করার প্রতীক হিসেবে দেখা যায়। পার্বতী একজন স্বাধীনচেতা নারী, যিনি সমাজের প্রথাগত নিয়ম মেনে চলার পরিবর্তে নিজের জীবনকে নিজের মতো করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
“বিন্দুর ছেলে”:
এ গল্পে শরৎচন্দ্র গ্রামের সহজ-সরল নারীদের জীবনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। নারীকে শুধুমাত্র পরিবারের দায়িত্ব বহনকারী হিসেবে নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এবং সমাজের পরিবর্তনের অংশীদার হিসেবে দেখা হয়।
- বেগম রোকেয়া:

বাংলাদেশ ও ভারতের নারীবাদী আন্দোলনের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া ছিলেন নারী শিক্ষা এবং অধিকার নিয়ে সংগ্রামী একজন লেখিকা। তার লেখায় তিনি নারীর মুক্তি এবং দায়িত্বকে কেবল গৃহস্থালির কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং নারীর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন।
“সুলতানার স্বপ্ন”:
এটি বাংলা সাহিত্যে নারীবাদী বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। রোকেয়া এখানে এমন এক জগতের কল্পনা করেন, যেখানে নারীরা শাসনক্ষমতায়, আর পুরুষেরা ঘরের কাজে নিয়োজিত। এই গল্পে নারীর ক্ষমতায়ন এবং তাদের সমতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন রূপায়িত হয়েছে।
“অবরোধবাসিনী”:
এই রচনায় বেগম রোকেয়া অবরোধ ব্যবস্থার কুফল এবং নারীদের প্রতি যে অবিচার করা হয়, তার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছেন। নারীর ঘরের দায়িত্ব পালন এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়ার সংগ্রাম এখানে চিত্রিত হয়েছে।
- তসলিমা নাসরিন:

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে নারীবাদী আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র তসলিমা নাসরিন। তার সাহিত্যে নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং নারীর স্বাধীনতা নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়। তিনি একজন বিতর্কিত লেখিকা হিসেবে পরিচিত হলেও তার সাহিত্যে নারীর দায়িত্ব এবং অবস্থান নিয়ে শক্তিশালী বিবৃতি রয়েছে।
“লজ্জা”:
এই উপন্যাসে তসলিমা নাসরিন ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা এবং এর ফলে নারী কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, সমাজের সংঘর্ষে নারী কেবল নিপীড়নের শিকারই নয়, বরং তার নিজের অধিকার রক্ষার সংগ্রামেও যুক্ত।
“আমার মেয়েবেলা”:
এটি তসলিমার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ, যেখানে তিনি তার শৈশব ও কৈশোরের অভিজ্ঞতা, সামাজিক এবং পারিবারিক দায়িত্ব ও সংগ্রাম নিয়ে আলোচনা করেছেন। নারী হিসেবে কীভাবে সমাজ তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় এবং তিনি কীভাবে তার অবস্থানের জন্য সংগ্রাম করেছেন, তা এখানে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।
- জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী:
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী বাংলা সাহিত্যের একজন গুণী সাহিত্যিক, যিনি নারীর সংবেদনশীল দিক নিয়ে বেশ কিছু রচনা করেছেন। তিনি নারীদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং তাদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন গল্পে আলোকপাত করেছেন।
“পদ্মাপুরাণ”:
এ উপন্যাসে তিনি পদ্মার চরিত্রের মাধ্যমে এক নারীর সংগ্রামী জীবন এবং তার সামাজিক দায়িত্বের প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন। পদ্মা শুধুমাত্র একটি গ্রামের গৃহিণী নয়, বরং সে একজন লড়াকু নারী, যে নিজের এবং পরিবারের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম করে।
- সিমোন দ্য বোভোয়া (Simone de Beauvoir):

সিমোন দ্য বোভোয়া ছিলেন একজন ফরাসি দার্শনিক এবং নারীবাদী লেখিকা, যিনি নারীর দায়িত্ব এবং সামাজিক ভূমিকা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। তাঁর “The Second Sex” বইটি নারীবাদী দর্শনের ভিত্তি স্থাপন করেছে। তিনি নারীকে কেবল সমাজের গৃহস্থালির দায়িত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে, তাদের স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন।
- ভার্জিনিয়া উলফ (Virginia Woolf):
ভার্জিনিয়া উলফ ছিলেন আধুনিক যুগের অন্যতম বিখ্যাত লেখিকা, যিনি নারীর সৃজনশীলতা এবং সমাজে নারীর অবস্থান নিয়ে লিখেছেন। তাঁর রচনা “A Room of One’s Own” বইটিতে তিনি নারীদের স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং নিজের জায়গার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। উলফ নারীর দায়িত্বকে কেবল পরিবারে সীমাবদ্ধ রাখার বিপরীতে, সৃজনশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের গুরুত্ব দেন।
বাংলা সাহিত্যে নারীর ভূমিকা যুগে যুগে পরিবর্তিত এবং প্রসারিত হয়েছে। প্রথমদিকে নারীদের গৃহস্থালির দায়িত্ব এবং পরিবারের প্রতি তাদের কর্তব্যকেই মূলত গুরুত্ব দেওয়া হলেও, আধুনিক কালে নারীর স্বাধীনতা, সামাজিক ভূমিকা এবং তাদের আত্ম-অন্বেষণের বিষয়টিও উঠে এসেছে। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বেগম রোকেয়া, তসলিমা নাসরিনসহ অন্যান্য সাহিত্যিকরা তাদের লেখনীতে নারীর দায়িত্ব, সংগ্রাম এবং তাদের অবস্থান নিয়ে চমৎকারভাবে আলোকপাত করেছেন। নারীরা আজ কেবল পরিবারের দায়িত্বে সীমাবদ্ধ নন, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরে নিজেদের অবদান রাখছেন এবং বাংলা সাহিত্য তাদের এ পরিবর্তনকে যথার্থভাবে প্রতিফলিত করেছে।
______________________
তথ্যসূত্র
- “বাঙালি নারীর কথা” – হুমায়ুন কবীর
- “নারী-প্রতিবিম্ব: ঊনবিংশ শতকের বাংলা সাহিত্য” – চৈতালী ভট্টাচার্য
- “বাঙালি সমাজে নারী” – রাখী রায়
- “স্মৃতি, সাধনা ও সংগ্রাম: নারীর আত্মকথা” – জ্যোতির্ময়ী দেবী, কমলা দাশগুপ্ত প্রমুখ (সম্পাদনা: মালবিকা কর)
- “নারীবাদ ও সাহিত্য: বাংলা সাহিত্যে নারী-চরিত্র” – সুনন্দা চক্রবর্তী
- “নারীর কথা: বাংলা সাহিত্যে নারীচরিত্র” – সীমা দাসগুপ্ত
- “Women in Modern Indian Literature” –edited by Lakshmi Holmström
- পরিচয় (বিশেষ সংখ্যা: নারী সংখ্যা) – সম্পাদক: সুশোভন অধিকারী