29 C
Kolkata
Saturday, 19 July, 2025

Buy now

spot_img

মানিক থেকে সত্যজিৎ 

২২ বছরের এক মেধাবী যুবক শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় এসেছিলেন একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজের জন্য। আসলে মননে ছিল তাঁর চিত্রাঙ্কন। তা পটে পরিবেশনার জন্য ছিল উদ্দীপনা। কিন্তু সহজসাধ্য সাফল্য মিটমিট করা তারার মতো। যে তারা ধ্রুবতারার মতো জ্বলে,তার অন্তঃ অগ্নি ততো বেশি করে পোড়ে। মানিক থেকে সত্যজিৎ হয়ে ওঠা বাঙালি তথা ভারতবাসীর অহংকার এই ব্যাক্তিত্য ও  তার জীবনী, যেন সে কথাই বলে। 

বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক ও কবি সুকুমার রায় ও সুপ্রভা দেবীর একমাত্র পুত্র শ্রী সত্যজিৎ রায় জন্মগ্রহণ করেন এই কলকাতায় ১৯২১ সালে ২রা মে । জন্মের তিন বছর পর পিতার মৃত্যু হলে মা সুপ্রভা দেবীর একক প্রচেষ্টায় তার মানিক থেকে সত্যজিৎ হয়ে ওঠার চিত্রনাট্য শুরু হতে থাকে।

প্রথম জীবনে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি নিয়ে পড়া শুরু করেন। পরবর্তীতে মা এর অনুরোধে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন।সেখানে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব, চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু ও বিনোদ বিহারি মুখোপাধ্যায়ের  সান্নিধ্য লাভ, তাঁকে চারুকলার প্রতি আরো আগ্রহান্বিত করে। অর্থাৎ বীজ বপনের পর এক পরিপূর্ণ বৃক্ষ হওয়ার পথের উপযোগী পরিবেশ মানিক কে সত্যজিৎ এর পথে নিয়ে যেতে সহায়তা করে। ১৯৪০ সালে তিনি কলকাতায় এসে ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি জে কিমার এ জুনিয়র ভিসুয়ালাইজার হিসাবে কর্ম জীবন শুরু করেন। কিন্তু ব্রিটিশ আধিপত্য হেতু সেই সংস্থা ছেড়ে তিনি যোগ দেন ডি কে গুপ্তর সিগনেট প্রেস এ। এটি একটি প্রকাশনা সংস্থা ছিল।সেখানে তিনি জিম করবেটের ম্যান ইটার্স অফ কুমায়ুন এবং জওহরলাল নেহেরুডিসকভারি অফ ইন্ডিয়ার প্রচ্ছদ তৈরী করেন। একজন শিল্পীর শিল্পে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকলে  তার প্রকাশও হয়ে ওঠে অনন্য। এখানে তিনি বিভূতি ভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের কালজয়ী বাংলা উপন্যাস “পথের পাঁচালির” ছোট সংস্করণ “আম আঁটির ভেঁপু” তে কাজ করেন। এটি তাঁকে এতটাই প্রভাবিত করে যে তিনি পরবর্তীতে তাঁর প্রথম চলচিত্রের বিষয় হিসাবে নির্বাচন করেন। 

শুরু হলো চিত্র ও নাট্যের মেল্ বন্ধনের প্রাথমিক খসড়া। জগৎকে সর্বত ভাবে অনুধাবনের এক বিস্তারিত দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা তিনি আন্তর্জাতিক চলচিত্র এর প্রতি উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি জ রনোয়ার তার দা রিভার  ছবির জন্য কলকাতায় আসেন। সেই সময় তার সাথে সত্যজিতের পথের পাঁচালির চলচিত্রায়ণ নিয়ে আলোচনা হলে তিনি তাকে উৎসাহ দিলেন এগিয়ে চলার জন্য। ১৯৫০ সালে লন্ডনে ইতালির লাদ্রী দি বিচিক্লেত্তে ছবিটি তাঁকে এতটাই প্রভাবিত করে যে তিনি চলচিত্রকার হিসাবে নিজের লক্ষ্য খুঁজে পান। 

শুরু হলো এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। ১৯৫২ সালে নিজের জমানো অর্থে অপেশাদার কলা-কুশুলিদের সাহায্যে প্রাথমিক দৃশ্য গ্রহণ শুরু করেন। কিন্তু পথের এই পাঁচালির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভবপর হয়ে উঠছিলোনা অর্থের জন্য। শেষে ১৯৫৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ঋণ দ্বারা ছবিটির নির্মাণ কার্য্য শেষ হয়। বাকিটা ইতিহাস। দ্যা টাইমস অফ ইন্ডিয়ার কথায় :- “একে অন্য যেকোনও ভারতীয় চলচিত্রের সাথে তুলনা করা অবাস্তব…পথের পাঁচালি হলো বিশুদ্ধ চলচিত্র”-

এরপর অপরাজিত,পরশ পাথর,জলসাঘর,অপুর সংসার,চারুলতা,দেবী,কাঞ্চনজংঘা,মহানগর,তিন কন্যা,কাপুরুষ মহাপুরুষ,জন অরণ্য,গণশত্রু,গুপী গাইন বাঘা বাইন,সোনার কেল্লা,জয় বাবা ফেলুনাথ   সর্বমোট ৩৬টি ছবি পরিচালনা করেন। অপরাজিত ভেনিসে গোল্ডেন লায়ন পুরস্কারে সম্মানিত হয়। 

“সত্যজিতের চলচিত্র না দেখা আর পৃথিবীতে বাস করে চন্দ্র সূর্য না দেখা একই কথা।”

আকিরা কুরোসাওয়া 

মণি মানিক্য 

  • চার্লি চাপলিনের পর সত্যজিৎ দ্বিতীয় ব্যাক্তিত্ব যাকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া হয়। 
  • ১৯৮৫ সালে ভারত থেকে তাকে দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। *১৯৮৭ সালে ফ্রান্স থেকে তাঁকে লেজিও দনরে পুরস্কার দেওয়া হয়। 
  • ১৯৯২ সালে আজীবন সন্মান স্বরূপ একাডেমি সন্মান সূচক পুরস্কারে পুরস্কৃত হন। 
  • মৃত্যর কিছুদিন পূর্বে ভারত সরকার দ্বারা তিনি ভারতরত্ন সন্মান পান। 
  • তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কার প্রদান করা হয়। 

পুরস্কার সন্মান খ্যাতির পাশাপাশি নেতিবাচক সমালোচনাও ছিল। ধীর গতির ছবি,অভিব্যক্তিহীন,আধুনিকতা বিরোধী,দারিদ্র রফতানি,বুর্জোয়া দৃশ্য থেকে বেরিয়ে তার সমাধান দিতে ব্যর্থ, এরকম বিভিন্ন ভাষায় সমালোচিত হতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু সুক্ষ দোত্যনা সহ চলচিত্র গঠনে যে তিনি অদ্বিতীয় ছিলেন সে কথা দা ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় বলা হয়েছে – “হু এলস ক্যান কমপিট্ “ ? 

চলচিত্রের পাশাপাশি তার সাহিত্যকর্মও ছিল সমান জনপ্রিয়। ফেলুদা,প্রফেসর শংকু,জটায়ু যেন বই এর পাতা থেকে উঠে আসা জীবন্ত চরিত্র যা আজও বাংলা সাহিত্যে পছন্দের প্রথম তালিকায় বিরাজ করে। 

পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী যিনি বাংলা সাহিত্যের মোর বদলে দেওয়া এক উজ্জ্বল দার্শনিক, লেখক, চিত্রকর, প্রকাশক এবং পিতা স্বনামধন্য লেখক ও কবি সুকুমার রায়ের পুত্র এই মহান ব্যাক্তিত্ব পারিবারিক সংস্কৃতির ধারক ও বাহক আজ চলচিত্র জগতে পৃথিবীখ্যাত। পারিবারিক প্রভাব তো বটেই,নিজ গুনে স্বয়ং সমৃদ্ধ সত্যজিৎ চিরকাল বাংলার কৃষ্টিতে উজ্জ্বল এক মানিক, যার গরিমায় গর্বিত আপামর বাংলা তথা বিশ্বের সকল চলচিত্রপ্রেমী  সে কথা বলা বাহুল্য। 

তথ্যসূত্র :-

Avatar photo
+ posts

একাধারে সাংবাদিকতা, মানবসম্পদ ও সৃজনশীল মিডিয়ায় সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে দীপান্বিতা আজ এক বহুমুখী লেখিকা। অনলাইন প্রকাশনা, ফিচার রচনা এবং স্ক্রিপ্ট উন্নয়নের ক্ষেত্রে তার অভিজ্ঞতা তাকে তীক্ষ্ণ সম্পাদকীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং গল্প বলার এক অনন্য দক্ষতা প্রদান করেছে। গণ সংযোগ ও মানবসম্পদ উন্নয়নে স্নাতকোত্তর দীপান্বিতা ডকুমেন্টারি স্ক্রিপ্টিং, ব্র্যান্ড স্টোরিটেলিং এবং গভীর গবেষণামূলক লেখায় এক উল্লেখনীয় অবদান রেখেছেন। প্রভাবশালী ব্লগ থেকে শুরু করে আকর্ষণীয় সামাজিক মাধ্যমের কনটেন্ট, বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠকদের চাহিদা অনুযায়ী তার লেখনী শৈলী সবক্ষেত্রেই অনন্য। বিশ্ব বাংলায় তাঁর কাজ স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতির এক প্রতিফলন।

দীপান্বিতা চক্রবর্তী
দীপান্বিতা চক্রবর্তী
একাধারে সাংবাদিকতা, মানবসম্পদ ও সৃজনশীল মিডিয়ায় সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে দীপান্বিতা আজ এক বহুমুখী লেখিকা। অনলাইন প্রকাশনা, ফিচার রচনা এবং স্ক্রিপ্ট উন্নয়নের ক্ষেত্রে তার অভিজ্ঞতা তাকে তীক্ষ্ণ সম্পাদকীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং গল্প বলার এক অনন্য দক্ষতা প্রদান করেছে। গণ সংযোগ ও মানবসম্পদ উন্নয়নে স্নাতকোত্তর দীপান্বিতা ডকুমেন্টারি স্ক্রিপ্টিং, ব্র্যান্ড স্টোরিটেলিং এবং গভীর গবেষণামূলক লেখায় এক উল্লেখনীয় অবদান রেখেছেন। প্রভাবশালী ব্লগ থেকে শুরু করে আকর্ষণীয় সামাজিক মাধ্যমের কনটেন্ট, বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠকদের চাহিদা অনুযায়ী তার লেখনী শৈলী সবক্ষেত্রেই অনন্য। বিশ্ব বাংলায় তাঁর কাজ স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতির এক প্রতিফলন।

প্রাসঙ্গিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here
Captcha verification failed!
CAPTCHA user score failed. Please contact us!

সাথে থাকুন

110FansLike
105FollowersFollow
190SubscribersSubscribe
- বিজ্ঞাপন -spot_img

বাংলা ক্যালেন্ডার

সাম্প্রতিক