এই মহামানব ছিলেন বাংলার এমন এক রূপকার, যিনি একাধারে ডাক্তার ধন্বন্তরী, ডাক্তার ভগবান আবার একাধারে অশান্ত উত্তপ্ত অসুস্থ বাংলাকে অসাধারণ দূরদর্শিতা ও অক্লান্ত প্রচেষ্টা দ্বারা সুস্থ করে আধুনিক উন্নত প্রগতিশীল বাংলায় রূপান্তরিত করার এক জাদুকর। ১লা জুলাই জাতীয় ডাক্তার দিবস হিসাবে পালন করা হয় যে বঙ্গ সন্তানের কারণে, সেই পথিকৃৎ ও তাঁর মহান কর্ম জীবন, এক জন্মদিবসকে জাতীয় ডাক্তার দিবসে পালন করবার স্বার্থকতাকে প্রভাবিত করে গেছেন সর্বত ভাবে। তিনি – বাংলার তথা ভারতের গর্ব ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়,পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় সাফল্যমন্ডিত মুখ্যমন্ত্রী, আধুনিক বাংলার রূপকার, জন-দরদী, লোক-কল্যাণকারী, হিতাকাঙ্খী এক মহামানব।
আজকের উন্নত বাংলা, যার দূরদৃষ্টির ফসল, সেই মহান ব্যাক্তিত্ব ডক্টর বিধান চন্দ্র রায় এর জন্মদিনটি সারা দেশ জুড়ে পালিত হচ্ছে জাতীয় ডাক্তার দিবস হিসাবে, আপামর বাঙালি তথা ভারতবাসীর কাছে দিনটি আনন্দের, গর্বের সাথে আবেগেরও, কারণ ১লা জুলাই তাঁর মৃত্যুদিবস ও বটে।
ডঃ বিধান চন্দ্র রায় : চিকিৎসক ও মানবসেবী
১৮৮২ সালের ১লা জুলাই বিহারের বাঁকিপুরে জন্ম নিলেন ঠাকুমার আদরের ভজন। পরবর্তীকালে ব্রাম্হ সমাজের স্রষ্টা শ্রী কেশব চন্দ্র সেন নাম দিলেন বিধান। ১৯০১ সালে কলকাতায় এসে ভর্তি হলেন কলকাতা মেডিকেল কলেজ এ। কলেজে তাঁর আদর্শ অধ্যাপক লিউকিসের থেকে তিনি শিখেছিলেন, চিকিৎসকের মন কখনো কঠোর হবেনা, মেজাজ কখনো কান্ত হবেনা, স্পর্শ কখনো কঠিন হবেনা। তাঁর অধীনেই শল্য চিকিৎসক রূপে কাজ শুরু করলেন। তার সাথে শুরু হলো ২ টাকায় রোগী দেখা। ১৯০৯ সালে লন্ডনে সেইন্ট বার্থলোমিউস কলেজে শল্য চিকিৎসার পাশাপাশি চর্মরোগ, এনাটমি, ফিজিওলজি চিকিৎসায় তিনি নজর কাড়েন। ১৯১১ সালে এফআরসিএস ও এমারসিপি ডিগ্রির অধিকারী হন। কিন্তু ইংরেজ অগ্রাধিকার বিষয়টির প্রাবল্যে এক বছর পরে ক্যাম্বেলে (এনআরএস) ডাক্তারি জীবন শুরু করেন। এই স্বল্প কালের মধ্যে তাঁর নাম পরিচিত হতে থাকে লোকের মুখেমুখে। সাধারণ মানুষ তাঁকে চিনতেন ধ্বন্বন্তরী ডাক্তার হিসাবে।
অবশ্যই তার কারণ ছিল – জানা যায় রোগী দেখে তার রোগ নির্ণয় করতে পারতেন ডঃ রায়। যেমন –

ছবি উইকিমিডিয়া’র সৌজন্যে
- একবার ভার্টিগো ও মাথা যন্ত্রনায় কাতর এক অসুস্থ ব্যাক্তিকে দেখে তিনি কাগজে লিখে দিলেন তিনটি শব্দ – রিভার্স ইওর হেড। জিজ্ঞাসু রোগীর আত্মীয়কে বুঝিয়ে দিলেন উত্তর দিকে মাথা রেখে শোয়ার কারণে তিনি নিজের দেহটিকে চৌম্বক শলাকা হিসেবে কাজ করাচ্ছেন। দিক পরিবর্তন করলে এই সমস্যা কেটে যাবে। বাস্তবিক রোগীর রোগ নিরাময় সম্ভব হয়েছিল।
- এমনই আর এক মাথা যন্ত্রনায় কাতর রোগীকে দেখে ওষুধ হিসাবে তিনি পরামর্শ দিলেন পাঁকা কাঁঠাল আনতে। এমন যন্ত্রণার এহেন চিকিৎসা পদ্ধতিতে হতবাক সবাই দেখলেন কানের পাশে বেঁধে রাখা সেই কাঁঠালের গন্ধে কিভাবে কানের ভেতরে ঢুকে থাকা পিঁপড়েরা বের হয়ে আসলো। পরামর্শ হিসাবে ডাক্তার বললেন পানা পুকুরে স্নান না করার কথা।
- একবার রাত্রে মহাকরণে নিজ কাজ সেরে তিনতলা থেকে নিচে নামার সময় নিচের এক তলা থেকে আগত কাশির শব্দ শুনে তৎক্ষণাৎ সেই ব্যাক্তিকে টিবি হসপিটালে ভর্তি হতে বলেছিলেন। পরীক্ষ্যায় জানা গেলো ব্যক্তিটি গ্যাংলিন টিবি দ্বারা আক্রান্ত। সাধে কি ডাক্তার ভগবান নাম ?
“আমি গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র বুঝিনা। শুধু বুঝি, সাধারণ মানুষকে কত বেশি সুবিধা দেওয়া যায় “
তিনি দেখেছিলেন, চিকিৎসার মাধ্যমে মানুষের মনের অনুভূতি অনুধাবন করা যায়। সাধারণ মানুষের মানসিক-আর্থিক-সামাজিক অবস্থার সাথে তিনি পরিচিত ছিলেন বলেই, তাঁর এই মহান হৃদয় দিয়ে তিনি পরবর্তী ক্ষেত্রে তার মুখ্যমন্ত্রীত্ব কালে তা কাজে লাগাতে পেরেছিলেন। প্রশাসনিক ক্ষমতার সব থেকে উল্লেখযোগ্য যে দিক -জন সাধারণের সমস্যা বোঝা ও তার সেবা ভার, তিনি তা তার ডাক্তারি পেশা থেকে অর্জন করেছিলেন।
আধুনিক বাংলার রূপকার : মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তার অবদান
দেশ ভাগ পরবর্তী বাংলার পরিস্থিতি
তখন এক অস্থির পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্যে বেকারিত্ব, কর্মহীনতা, প্রবল আর্থিক চাপ, দেশ ভাগের পরবর্তী শরণার্থী প্রবেশ, খাদ্যাভাব, শিল্প হীন এক বিষম সংকটময় সময়। ডাক্তার রায় ঠিক এমন সময় হাল ধরলেন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে। বুঝলেন পশ্চিমবঙ্গের যন্ত্রণা। দূরদৃষ্টিতে পরিমাপ করলেন এই সমস্যা সমাধানের উপায়। তিনি –
- যোজনা কমিশন থেকে বরাদ্দ টাকায় দুর্গাপুর, কল্যাণী ও বিধাননগর উপনগরী তৈরী করার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন।
- দুর্গাপুরে ইস্পাত কারখানা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, দুর্গাপুর ব্যারাজ তৈরী করলেন।
- কলকাতায় রাষ্ট্রীয় পরিবহন ব্যবস্থা শুরু করলেন।
- শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দিতে রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ ও বান্ডেল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরী করলেন।
- শুরু করেন হরিণঘাটা সরকারি দুগ্ধ প্রকল্প।
- যাদবপুরে টিবি হাসপাতাল ও চিত্তরঞ্জন সেবা সদন তৈরির উদ্যোগ নিলেন।
- হিন্দুস্তান মোটোর্স্, দে’জ মেডিক্যাল, গ্লুকোনেট প্রভৃতি বেসরকারি শিল্পের প্রসার তাঁর মাধ্যমে শুরু হলো।
- রাজ্যে জ্বালানি তেল শোধনাগার –হলদিয়া পেট্রো কেমিক্যালস তাঁর ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ রূপ নিলো।
- অশোকনগর হাবড়ায় তৈরী হলো বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থী শিবির ও তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা।
রাজনীতিতে নতুন হলেও অনবদ্য কাজের মাধ্যমে বিধান রায় সমাজে নিজেকে প্রতিষ্টিত করেছেন।
—নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু
নতুন প্রজন্মের জন্য তাঁর বার্তা

বাংলার উন্নীতিতে ডঃ রায়ের দূরদৃষ্টি, তার সফল প্রয়োগ, ডাক্তারি পরিষেবায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৬১ সালে ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত হন তিনি। তাঁর জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কি অসম্ভব দৃঢ় প্রতিজ্ঞ আত্ম- নিষ্ঠার অধিকারী এই মহা মানব তাঁর নিজ জীবন দ্বারা আদর্শ তৈরী করে গেছেন। সেকালীন সময়ে ব্রিটিশ আধিপত্যে শুধুমাত্র ডাক্তারি পড়তে কত বাঁধার সম্মুখ্যিন হতে হয়েছিল তাকে। সেসব নিজ আত্মবলে দূর করে নিজ লখ্যে সফল হয়েছেন। বাংলার বারো ভূইঁয়াদের এক ভূইঁয়া ছিল তাঁর প্রপিতামহ। পরিবার থেকে পেয়েছিলেন আত্মমর্যাদা,সেবা বোধ।
মুখ্যমন্ত্রীত্ব পদে থাকাকালীন যখন তাঁর মাসিক আয় ৪২ হাজার টাকা থেকে ১৪ হাজার টাকা হয়েছিল,তখন লোভনীয় ডাক্তারি পেশা থেকে রাজ্যের মানুষের সার্বিক উন্নতিতে মন দিলেন তিনি। তখন বিনামূল্যে ১৬ জন করে রোগী দেখতেন প্রতিদিন।
“রোগীর চিকিৎসা করার সময় একজন চিকিৎসক নিজের আরাম আয়েশ স্বার্থের কথা ভাবেন না। বৃহত্তর পরিসরে মানুষের জন্য কাজ করতে চাইলেও তেমনি নিজের চাওয়া পাওয়া লোভ লালসা ভুলতে হবে।”
রবীন্দ্রনাথ থেকে গান্ধীজি, মতিলাল নেহেরু থেকে জে এফ কেনেডি ,ক্ষেতের চাষি হোক বা সাফাই কর্মী, সবাই ছিল তাঁর পেশার আড়ালে এক একজন শিক্ষক। যাদের মুখ দেখে তাদের অন্তরের জটিল চিত্র গুলো অনুধাবন করে নিতে পারতেন খুব সহজেই। তাই তিনি সাধারণের ডাক্তার ভগবান। এই পরিষেবার মাধ্যমেই মানুষের সুখ-দুঃখ্য বোঝার কান্ডারি হয়ে পরবর্তীতে এক অসুস্থ বাংলাকে সুস্থ করে আগামী সময়ের এক উজ্জ্বল বাংলা গড়ে তুলেছিলেন। সঙ্গী ছিল দূরদৃষ্টি, প্রত্যয়,আর বাংলার প্রত্যাশা কে পরিপূর্ণ করার রূপায়ণ শক্তি। সে সময়ে সরকারি আর্থিক অনুদান ছাড়া পথের পাঁচালি হয়তো সম্ভব হতো না।
আজকের উন্নত পশ্চিমবঙ্গ তার দূরদৃষ্টি, আত্মত্যাগ ও কর্মনিষ্ঠার প্রতিচ্ছবি।
জাতীয় চিকিৎসক দিবসে জানাই আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম।
তথ্য সূত্র ➖
১) আনন্দবাজার
২) সববাংলায়
৫) লেখালিখি