বাঙালির ভুরিভোজের শেষ পাতে মিষ্টিমুখ হবে না! এ আবার হয় নাকি! মিষ্টির মধ্যে সর্বপ্রথম দইটা কিন্তু থাকতেই হবে। শুধু বাঙালি কেন, এমন অনেক অবাঙালিও আছেন; যারা শেষ পাতে দই খেতে পছন্দ করেন। তাদের নাম না হয় পরে কোন একসময় বলা হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক “অমল ও দইওয়ালা”র কথা আমরা প্রায় সকলে পড়েছি কিংবা শুনেছি। আজ বলা হোক এক অদ্ভুত দইয়ের কথা, যা ঝুড়িতে পাতা হয়ে থাকে। এই রে আপনারা এত অবাক হচ্ছেন কেন? সত্যি বলছি, ঝুড়িতেও দই পাতা হয়। তার স্বাদ নাকি অতুলনীয়; যে বা যারা সেই ঝুড়ির দই একবার খেয়েছেন, তাদের মুখে এখনও সেই স্বাদ লেগে আছে।

বহরমপুর কিংবা মুর্শিদাবাদের প্রসিদ্ধ ‘ঝুড়ি দই’। মাটির ভাঁড় বা হাঁড়ি নয়, এখানে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বানানো ঝুড়িতেই পাতা হয় দই। কিন্তু ঝুড়িতে তো ফাঁক থাকে, তাতে দই পাতা আদেও কি সম্ভব? মুর্শিদাবাদ দৌলতপুরের হরিশপুর অঞ্চল, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমের সীমান্তের কাছে রঘুনাথগঞ্জের ঝুড়ি দই বাংলায় প্রসিদ্ধ। স্বাদ ও গুণগত মানের দিক থেকে এই দইকে অনেকেই ‘শ্রেষ্ঠ’ বলে মনে করেন। এই দইয়ের বৈশিষ্ট্য হল, বাঁশের কঞ্চির ছোটো ঝুড়ির গায়ে দইয়ের শক্ত সাজ বা ক্ষীরের প্রলেপ মাখিয়ে দিয়ে ছিদ্রগুলি বন্ধ করে সেই ঝুড়িতে পাতা হয় দই। এই দইয়ের উপরে পুরু ঘিয়ে রঙের আস্তরণ থাকে, তা সরিয়ে ফেললেই মিলবে সাদা রঙের দই। স্বাদে অম্লমধুর। খেতে অতুলনীয়।
হরিশপুরের দই ব্যবসায়ী গৌতম ঘোষ বংশ পরম্পরায় দই বিক্রি করে আসছেন, তাঁর বাবা দই বানিয়ে সোনার মেডেল পেয়েছিলেন। গৌতম বাবুদের প্রায় দুশো বছরের পারিবারিক ব্যবসা। ১৯৫৩-৫৪ সালে বিধানচন্দ্র রায় যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন সেই দই খেয়ে গৌতম বাবুর বাবাকে পুরস্কৃত করেছিলেন।

শেষ পাতা দই হলে তবে বাঙালির পেটের সঙ্গে মনেরও তৃপ্তি লাভ হয়। দুগ্ধজাত খাবারের মধ্যে দই যে একেবারে প্রথম সারিতে সে কথা বলাই বাহুল্য। তবে দুই প্রেমিকের অনেকেরই হয়তো এই দইয়ের ঠিকানা অজানা। ভাঁড় বা হাঁড়ি ছেড়ে দই পাতা হয় ঝুড়িতে, এই ব্যতিক্রমী দইয়ের একমাত্র ঠিকানা হলো মুর্শিদাবাদ।
মুর্শিদাবাদ, একসময় বাংলার নবাবদের রাজধানী ছিল। তার রাজকীয় ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে এক অনন্য মিষ্টান্ন ঐতিহ্য বহন করে চলেছে – “ঝুড়ি দই”। এই দই সাধারণ দই নয় বরং বাঁশের তৈরি এক বিশেষ ঝুড়ি বা টোপলা-তে জমিয়ে রাখা হয় বলে এর নাম ঝুড়ির দই।
এই দইয়ের উৎপত্তি ১৮শ বা ১৯শ শতকে বলে মনে করা হয়, যখন নবাবদের দরবারে নানা ধরনের উপদেয় খাবারের পরিবেশিত হতো। ঠান্ডা ও ঘন টেক্সচারের মিষ্টি দই সেই সময় থেকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দইয়ের জন্য এই ঝুড়ির ব্যবহার শুরু হয় কারণ, বাঁশের তৈরি ঝুড়ির প্রাকৃতিক ছিদ্র দিয়ে অতিরিক্ত জল চুনিয়ে বেরিয়ে যায়। ফলে দই আরো ঘন মোলায়েম ও মিষ্টি হয়।
ঝুড়ির দই এর বিশেষত্ব হলো তার ঘনত্ব, প্রাকৃতিক মাটির গন্ধ এবং সামান্য মিষ্টি ও টক স্বাদ। যেহেতু এটি ঝুড়িতে জমানো হয়, তাই তার গায়ে এক ধরনের দেশি গন্ধ ও ঘনত্ব আসে যা প্লাস্টিক বা মাটির হাঁড়িতে দইতে পাওয়া যায় না। অনেক সময় এই দইয়ের উপর হালকা সোনালী ক্রিম স্তর জমে, যেটি গরমকালে জমা দুধের সঙ্গে মিশে গিয়ে তৈরি হয়; যা দইপ্রেমীদের কাছে অত্যন্ত লোভনীয় আকর্ষণীয়। ভ্রমণপিপাসু মানুষদের কাছে মুর্শিদাবাদ এর ইতিহাসের সঙ্গে মিশে গেছে এই “ঝুড়ির দই” এর স্বাদ। সময় অসময় তা ছড়িয়ে পড়বে পৃথিবীর নানান বুকে। আপনারা যদি কখনোই এই স্বাদ গ্রহণ করতে চান, তাহলে যে যে দোকানগুলোতে অবশ্যই এই দইয়ের সন্ধান পাবেন সেগুলি হলো:
১. দিলীপ পাল দই দোকান
২. রবীন পাল মিষ্টান্ন ভান্ডার
৩. গোলাপ মিষ্টান্ন ভান্ডার, বহরমপুর
৪. রাজা পাল দই দোকান
___________________________________________________
গ্রন্থপুঞ্জ:
১। History of Iconic Indian Sweets
২। The stories behind many of Bengal’s beloved sweets are historic and layered
৩। প্রাচীন বাঙালির খাদ্যাভ্যাস: আলপনা ঘোষ
৪। বাঙালির খাদ্যকোষ: মিলন দত্ত
৫। YouTube Channel: http://Foodka Series, Bong Eats,
৬। তথ্য গ্রহণ সহায়তায়: হামিম মন্ডল ( মুর্শিদাবাদ)
৭। https://murshidabad.gov.in/history/
৮। ছবি: Adobe Stock