কথায় বলে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য। ভারত-বর্ষে এই রূপচর্চার ক্ষেত্রেও সেই বৈচিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। পারম্পরিক ঐতিহ্যগত নিয়মে মেনে চলা কিছু রীতিনীতি– যার মূল সুর সৌন্দর্য্য ও তার বিকাশ। এই ভারতের এতো বিস্মৃত অবয়বে জলবায়ুর প্রকার হেতু খাদ্যাভ্যাস, পোশাক পরিধান, ব্যাবহারিক চাল চলন অভ্যাসে যেমন বিভিন্নতা দেখা যায়, ঠিক তেমনই এক এক জায়গায় এক এক রকমের সৌন্দর্য্য চর্চাতেও ঠিক সেই আভাস মেলে। এই উপাখ্যানের প্রতিটি উপাদানই প্রাকৃতিক সেই স্থান জনিত সহজলভ্য এবং বহুদিন ধরে চলে আসা ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী বা গুজরাট থেকে অরুণাচল-প্রদেশ হোক, সৌন্দর্য্য কে উজ্জ্বল রাখতে রূপচর্চার এই সাতকাহন বহুযুগ ধরে চলে আসা সংস্কৃতির এক অঙ্গ। এই সুবিস্তারিত কায়ায় রত্ন সজ্জিত গুপ্তধনের খোঁজ দেখে নেওয়া যাক।
ভারতবর্ষ হলো সৌন্দর্য্যের গুপ্তধন। এখানে আয়ুর্বেদিক চর্চার পাশাপাশি ঐতিহ্যগত কিছু রূপচর্চাও বিদ্যমান। স্থান এবং আবহাওয়া অনুযায়ী এর প্রকার ভেদ ও রয়েছে। রূপচর্চার এহেন বৈচিত্রের মধ্যে সৌন্দর্য্যের ঐক্য-খানি খুঁজে নেওয়া যেতে পারে খুব সহজেই।
কাশ্মীর -কাশ্মীরে কেশর সুলভ। এটি ত্বকের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কেশর বেশ ব্যায় সাপেক্ষ্য হওয়ায় অল্প পরিমানে কাঁচা দুধের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। কাঁচা দুধ সাধারণত ত্বক কে আর্দ্র রাখে, কেশর ত্বকের জৌলুস আনতে সাহায্য করে। যেহেতু কাশ্মীর বছরের বেশিরভাগ সময় তুষারাবৃত বা ঠান্ডায় সিক্ত থাকে তাই চেহারার জন্য নিতে তারা ঐতিহ্যগত ভাবে এই দুধ-কেশর এর মিশ্রণ টি ব্যবহার করে থাকে। এছাড়াও কাশ্মীরে আখরোট পাওয়া যায়। তাই রূপচর্চায় তারা আখরোট ও দুধের প্রলেপ ত্বক পরিষ্কারে ধারাবাহিক ভাবে ব্যবহার করে আসে।
লাদাখ – লাদাখ প্রদেশ উচ্চ উচ্চতায় অবসানের জন্য এখানে সূর্যের তাপ এর প্রকোপ কম ,তাছাড়াও বাতাস অত্যন্ত শুষ্ক। কিন্তু প্রকৃতি এখানে তার সমাধানও দান করেছে। কাশ্মীরের মতো এখানেও খুবানি উৎপাদন হওয়ার জন্য খুবানি তেল যা এটির শাঁস এর থেকে পাওয়া যায় তা সহজ লভ্য। সুতরাং ত্বকের শুস্ক ভাব , অতি ঠান্ডায় ত্বক লাল হয়ে যাওয়া ,এসবের থেকে মুক্তি পেতে খুবানি তেল তারা ব্যবহার করে। এটি ত্বকের হারানো আর্দ্রতা ফেরাতে ও ত্বকের সমস্যা থেকে মুক্ত রাখতেও সাহায্য করে।
আসাম – আসামের বিখ্যাত বিহু উৎসবে একটি রীতি প্রচলিত আছে , আর তা হলো, হলুদ এবং মুসুরির ডাল বেটে তাকে প্রলেপ হিসাবে লাগানো। এই মিশ্রণটি ত্বক পরিষ্কার করে তার হারানো উজ্জ্বলতা ফেরাতে অভাবনীয় কাজ করে। হলুদ ত্বকের ক্ষত ,দাগ ও জ্বালা থেকে মুক্তি দেয় যেখানে মুসুরির ডাল ত্বক গভীর ভাবে পরিষ্কার করে।
মণিপুর– স্থান ও তার পরিবেশ অনুযায়ী রীতি নীতির তারতম্য ঘটে। যেমন মনিপুরের তাংখুল নাগা জাতির চাল ধোয়া জল দিয়ে চুল পরিষ্কার কে তাদের ঐতিহ্যের একটি রীতি ভেবে থাকে। এই চাল ধোয়া জল এর ব্যবহার কোনো নতুন কিছু নয়। কারণ অনেকেই এটিকে চুলের উজ্জ্বলতা ফেরাতে ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু মনিপুর এ এটি বিশেষ ভাবে ব্যবহার হয় কারণ এখানে ধান চাষ করা হয়। ধান থেকে তৈরী চাল সারা রাত জলে ভিজিয়ে পরের দিন তা চুলে ব্যবহার করা হয়। মনে করা হয়, এটি চুলের বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে।
রাজস্থান –ভারতের পশ্চিম অংশে মুলতানি মাটির সহজলভ্যতার কথা কে না জানে। তাই এখানকার অধিবাসীরা রূপচর্চাও মুলতানি মাটি প্রভূত পরিমানে ব্যবহার করে থাকে। মুলতানি মাটি ত্বকের ব্রণ ফুসকুড়ি দূর করতে ও ত্বক দাগহীন উজ্জ্বল রাখতে সাহায্য করে। শুষ্ক ত্বকের জন্য মুলতানি মাটি ও কাঁচা দুধ এবং তৈলাক্ত ত্বকের জন্য মুলতানি মাটি গোলাপ জল ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
কেরালা – ভারতের দক্ষিন অংশে সমুদ্র উপকূলবর্তী হওয়ায় নারকোলের প্রচুর ফলন দেখা যায়। আবহাওয়া এখানে উষ্ণ ও আর্দ্র। নারকোল তেল ও নারকোল দুধে আছে ত্বক আর্দ্র রাখার প্রাকৃতিক গুন। তাই কেরালাবাসীর কাছে নারকোল তেলের ব্যাবহারিক উপযোগিতা বর্তমান। তাছাড়াও গরমে ত্বকের জেলা উপশমেও নারকোল তেল ও দুধ কার্যকরী।
তামিলনাড়ু – মাইসোরের চন্দন ভারত বিখ্যাত। তামিলনাড়ুতে এই চন্দন শুধুমাত্র রূপ চর্চায় নয়, বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানেও প্রাচীন সামাজিক রীতি হিসাবে এটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। চন্দন ত্বক শীতল করতে সাহায্য করে। এছাড়াও ভারতের বিভিন্ন স্থানে এটি সুগন্ধি ফেস-প্যাক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। গরমে চন্দনের ব্যবহার ত্বক কে শীতলতা প্রদান করে যা সাময়িক আরাম দেয়।
ভারতে স্থান ও কালের বিভিন্নতা হেতু রূপ চর্চার প্রাথমিক উপাদানে রকমফের দেখা যায়। উত্তরে সহজলভ্য আখরোট হোক বা দক্ষিনে চন্দন, পূর্বে হলুদ-মুসুরির জাদু হোক বা পশ্চিমে মুলতানির প্রভাব,এ সবই বহু সময় ধরে সৌন্দর্য্য বর্ধনে তো বটেই ঐতিহ্যগত ভাবেও রীতি নীতির আড়ালে উজ্জলিত করে আসছে এই সংস্কৃতি কে। সব থেকে বড় প্রাপ্তি হয় তখন, যখন এই হাতের নাগালে, সহজলভ্য, কম দামে এই সব উপকরণ আট থেকে আশির মুখে নির্মল হাসি ফোটাবার দায়িত্বটি সামলাতে পারে খুব সহজেই।
তথ্যঃসূত্র :
একাধারে সাংবাদিকতা, মানবসম্পদ ও সৃজনশীল মিডিয়ায় সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে দীপান্বিতা আজ এক বহুমুখী লেখিকা। অনলাইন প্রকাশনা, ফিচার রচনা এবং স্ক্রিপ্ট উন্নয়নের ক্ষেত্রে তার অভিজ্ঞতা তাকে তীক্ষ্ণ সম্পাদকীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং গল্প বলার এক অনন্য দক্ষতা প্রদান করেছে। গণ সংযোগ ও মানবসম্পদ উন্নয়নে স্নাতকোত্তর দীপান্বিতা ডকুমেন্টারি স্ক্রিপ্টিং, ব্র্যান্ড স্টোরিটেলিং এবং গভীর গবেষণামূলক লেখায় এক উল্লেখনীয় অবদান রেখেছেন। প্রভাবশালী ব্লগ থেকে শুরু করে আকর্ষণীয় সামাজিক মাধ্যমের কনটেন্ট, বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠকদের চাহিদা অনুযায়ী তার লেখনী শৈলী সবক্ষেত্রেই অনন্য। বিশ্ব বাংলায় তাঁর কাজ স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতির এক প্রতিফলন।