বঙ্গ নারী অঙ্গে শাড়ি চমকিত রূপ যেন নয়ন বিভাবরী
এমনও পরিধান কে দিলো উপহার? ইতিহাসে জ্ঞানালোক করি –
যদি বলা হয় বাঙালি নারী বলতে লাল পার সাদা শাড়ির কোনো সুদর্শনার স্নিগ্ধ উপস্থিতি মনে আসে ,তবে খুব ভুল বলা হবেনা। কারণ শাড়ি তেই বাঙালি তনয়ার আর এক পরিচিতি। বাঙালি কি তাই শাড়িকেই বেছে নিলো? নাকি শাড়ি বেছে নিলো বাঙালি নারীকে। ইতিহাসের পাতা উল্টে একটু বরং দেখে নেওয়া যাক , কেন বঙ্গ নারীর মন মজলো আঁচল-রাঙা শাড়িতে।
শাড়ির ইতিবৃত্য
সেই দীর্ঘ অতীতের বৈদিক যুগ, মৈত্রেয়ী যুগ , মধ্য যুগ পেরিয়ে আজকের সে আধুনিকা। সুতরাং ঐতিহাসিক মূল্য এর কম নয়। ৫০০০ বছর আগের সিন্ধু সভ্যতা থেকে শুরু করে সিঞ্চন, বুনন, নকশা ও পরিধান কৌশলের মাধ্যমে নিজেকে ঐতিহ্যময়ী রূপে ধরে রাখার প্রসংশার দাবি রাখে সে। সংস্কৃত শাটী (কাপড়ের টুকরো) আর পালি ভাষার শাড়ি থেকে সে নাম পেয়ে আজ বিবর্তীতা আধুনিকা বঙ্গ রমণীর হৃদয়রানী। গুপ্ত যুগে, শত বল্লিকা হস্তী-সুন্দ্কা নামে ,মহাকবি কালিদাসের কুমার সম্ভবে উধৃত আছে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি।
মধ্যবর্তী সময়ে বাংলায়, শাড়ি জড়িয়ে ছোট করে পড়ার রীতি ছিল যাকে আটপৌড়ে সাজ বলা হতো। কারণ ছিল মাঠে ঘাটে কাজ আর ঘর একই সাথে পরিচালনার জন্য কর্ম উপযোগী পোশাক পরিধান। তারপর এলো চার দেওয়ালের মাঝে বন্দী দীর্ঘায়িত শাড়ির আঁচলে বাধা চাবির গোছাখানি – যা ছিল, গৃহিণীর শক্তির প্রতীক।

এই আটপৌরে শৈলীর পালা বাদল ঘটলো বাংলার ঠাকুর বাড়ি তে। যখন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহধর্মিনী শ্রীমতী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী শাড়ি পড়ার এই শৈলীটি বদ্লে দেন। বলা যেতে পারে এক বিপ্লব ঘটে গেলো তৎকালীন ব্রাম্ভ সমাজে। ঔপনিবেশিক অতীত স্বীকৃতির সাথে পারসী নিভি শৈলীর মেল্ বন্ধন ঘটিয়ে শাড়ি কে রাতারাতি আধুনিক করে তুললেন তিনি। বাঁ কাঁধে শাড়ির আঁচল দিয়ে শাড়ি পরিধানের এই শৈলী আজও বর্তমান।
ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী কেশব চন্দ্র সেনের কন্যা কুচবিহারের মহারানী সুনীতি দেবী তার পুত্রবধূ মহারানী ইন্দিরা দেবী এবং মহারানী সুনীতি দেবীর পৌত্রী মহারানী গায়েত্রী দেবী শাড়ি পড়ার শৈলীতে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। মনে রাখতে হবে এই ব্রামহ সমাজ ছিল নারী স্বাধীনতা আনয়নের এক অন্যতম বিপ্লবের নাম। নারীরা তখন ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে জনসাধারণের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ পায়। তাই এই পরিবর্তন প্রয়োজনীয় ছিল।

আজকের দিনে শাড়ির বৈশিষ্ঠ অনুযায়ী হরেক রকম সম্ভার মেলে। কিন্তু মধ্যবর্তী যুগে শাড়ি বলতে সুতির শাড়ি বোঝানো হতো,পরে মোঘল এবং ইংরেজ আমলে নানা বৈচিত্র এসে যুক্ত হয়।

বর্তমানে শাড়ির রকমফের ? তার সম্ভার কম নয়। জামদানি, বালুচরি, কাঁথা মসলিন, বেনারসী, সুতি, খাদি, টাঙ্গাইল, বাটিক, মনিপুরী, সিল্ক,তসর,শান্তিপুরী, বেগমপুরী,খেশ,ব্লক প্রিন্ট, গ্রামীণ চেক্, মধুবনী,চিকণ,নেট,কাঞ্জিভরম,বাদনি ,পশমিনা ভেল্ভেট,চান্দেরি, লিনেন ইত্যাদি।
জামদানির ইতিহাস -মূলত চার রকমেরহয়ে থাকে -ঢাকাই ,টাঙ্গাইল ,শান্তিপুরী ,ধনেখালী। পারসী থেকে আসা এই শাড়ি মসলিন সুতো দ্বারা বোনা হয়ে থাকে যার আর এক নাম শবনম , অর্থশাস্ত্রে মসলিন এর উল্লেখ আছে যখন ভারত বর্ষ চীন আরব ও ইতালির সাথে ব্যবস্যা বাণিজ্য করতো। জামদানি তৈরিতে গভীর মনোযোগ ও কঠিন পরিশ্রম লাগে, যার কথা টেইলর জেমস এর ডেস্ক্রিপটিভে অফ হিস্টরিকাল একাউন্ট অফ টি কটন ম্যানুফ্যাকচারার (১৮৫১) বইটি থেকে জানা যায়।
বালুচরির ইতিহাস -১৮ শতকে ইংরেজদের আমলে মুর্শিদাবাদে সিল্ক বুনন সমৃধ্ধি লাভ করেছিল। মুঘল সময় মুর্শিদ কুলি খান তার রাজধানী গঙ্গা নদীর ধারে বালুচরে নিয়ে আসেন। তার সাথে আসেন তার সেলাই বুনন কারিগররা। সেই সময়ের বালুচরি শাড়িতে নানা জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠতো। পরবর্তীতে এই শাড়িতে সামাজিক-রাজনৈতিক ছবি ধরা দিতে শুরু করে। ব্ন্দে মাতরম স্বাধীনতাকালীন বার্তা ফুটে উঠতে থাকে এর আঁচলে। বন্যাজনিত কারণে পরবর্তীতে বালুচর থেকে তারা চলে আসে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে।
কাঁথার ইতিহাস – এই শাড়ি মূলত শাড়ি হিসাবে নয় বরং ছোট কাপড়ের টুকরোতে সাজানো সুতোর কাজ উপহার হিসাবে পাঠানো হতো।পরবর্তী সময়ে শাড়ি হিসাবে এর নকশায় স্থান পায় ফুল থেকে ফল,পশুপ্রাণীর চেহারা থেকে মানুষ এর রূপ অবধি। এটি মহিলা সংক্রান্ত কাজ বলে সান্ধ্যকালীন কাজের অবসরে নারীর স্বপ্ন,ইচ্ছে পূরণের নানা গল্প কথা সুতির বুননে লেখা হতে থাকে এই শাড়িতে। নকশি কাঁথার মাঠের মতো না জানি কত আবেগ জড়িয়ে আছে এই কাঁথায়।
শাড়ির যাত্রা শুরু হয়েছিল তুলো দিয়ে। তখন বঙ্গে কার্পাস তুলোর চাষ করা হতো। শাড়ি এই কারু শিল্প কে এগিয়ে নিয়ে গেছে। বাংলার শাড়ি বলতে তাঁত এর শাড়িই প্রধান, এটি তৈরী হয় নদিয়ার শান্তিপুর ও তার পার্শবর্তী অঞ্চলে। এই শান্তিপুরী শাড়ি ২০০৯ সালে জি-আই ট্যাগ এর স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৫ শতকের গোড়ার দিকে বাংলার গৌড়ের রাজা গণেশের সময় এই তাঁত শিল্পের সৃষ্টি হয়।
হুগলি জেলার ধনিয়াখালি স্থানে ধনেখালি শাড়ির সৃষ্টি হয়। প্রথম দিকে রং হতো তুষার ,পার হতো লাল বা কালো, সাথে থাকে খেজুরচুরি নকশা (দুটি ভিন্ন রঙের সুতোর কাজ )শাড়িতে অনন্যতা আনার জন্য।কোরিয়াল শাড়ি ছিল আর এক বিখ্যাত শাড়ি যা মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম এ তৈরী করা হতো জালা পদ্ধতির সাহায্যে। গরদ শাড়ি তৈরী হয় বোম্বেস মরি নামক সিল্ক পোকা থেকে,নাম টি এসেছে গোরো শব্দ থেকে যার অর্থ সাদা বিশুদ্ধতার প্রতীক স্বরূপ। মির্জাপুরের তাঁতি মৃত্যুঞ্জয় সরকার এর সৃষ্টিকর্তা। ২০২৪ এই জি ট্যাগ এর স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতীয় তাঁত শিল্প দিবস ৭ই অগাস্ট। তাঁত শিল্প প্রচার ও প্রসারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার অনেক কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন,শিল্পীদের সম্মান রক্ষার্থে। ২১ সে ডিসেম্বর জাতীয় শাড়ি দিবস হিসাবে পালিত হয়।
এহেন বঙ্গে এত স্মৃতি বিজড়িত অতীতে রাঙিয়ে বাঙালি নারী আর শাড়ি যেন একে অপরের পরিপূরক, আর তাই আজও যেন একই গল্প কাঁথায় আবেগে বুনে চলেছে সেই সোনায় মোরা ঐতিহ্যের ইতিহাস,বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে ।
তথ্যসূত্রঃ
একাধারে সাংবাদিকতা, মানবসম্পদ ও সৃজনশীল মিডিয়ায় সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে দীপান্বিতা আজ এক বহুমুখী লেখিকা। অনলাইন প্রকাশনা, ফিচার রচনা এবং স্ক্রিপ্ট উন্নয়নের ক্ষেত্রে তার অভিজ্ঞতা তাকে তীক্ষ্ণ সম্পাদকীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং গল্প বলার এক অনন্য দক্ষতা প্রদান করেছে। গণ সংযোগ ও মানবসম্পদ উন্নয়নে স্নাতকোত্তর দীপান্বিতা ডকুমেন্টারি স্ক্রিপ্টিং, ব্র্যান্ড স্টোরিটেলিং এবং গভীর গবেষণামূলক লেখায় এক উল্লেখনীয় অবদান রেখেছেন। প্রভাবশালী ব্লগ থেকে শুরু করে আকর্ষণীয় সামাজিক মাধ্যমের কনটেন্ট, বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠকদের চাহিদা অনুযায়ী তার লেখনী শৈলী সবক্ষেত্রেই অনন্য। বিশ্ব বাংলায় তাঁর কাজ স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতির এক প্রতিফলন।