29 C
Kolkata
Saturday, 19 July, 2025

Buy now

spot_img

ঋতুপর্ন ঘোষ’এর মননে রবীন্দ্রনাথ

“অন্তর মম বিকশিত করে, অন্তরতর হে”— রবীন্দ্রনাথের এই পংক্তিটি যেন ঋতুপর্ণ ঘোষের সৃষ্টিশীল জীবনের অন্তরস্বর। তাঁর ছবিগুলো শুধু দৃশ্য নয়, সেগুলি ছিল অন্তরের বিকাশ, আত্মার লড়াই, এবং নিজের পরিচয়কে উপলব্ধি করার এক দীর্ঘ পথ। এই যাত্রায় তাঁর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সঙ্গী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর কবিতা, নাটক, গান, উপন্যাস—সবই ঋতুপর্ণের ভেতরে গেঁথে গিয়েছিল এক মর্মান্তিক অনুভবের মতো। এই রবীন্দ্র-সংলগ্নতা কেবল শিল্পশৈলীর দিক থেকে নয়, আত্মপরিচয়ের গভীর স্রোতেও ছাপ ফেলেছে মনের গভীরে। 

রবীন্দ্রনাথ রচিত ঋতুপর্ণ ঘোষ এর চলচিত্র

ঋতুপর্ণ ঘোষ রবীন্দ্রনাথকে কখনো সাহিত্যিক হিসেবে গ্রহণ করেননি কেবল, তিনি তাঁকে দেখেছেন এক জীবন্ত সত্তা হিসেবে—যিনি কথা বলেন, প্রশ্ন করেন, ছায়া হয়ে পাশে থাকেন, আবার বিদ্রোহে উস্কানিও দেন। তাঁর সিনেমার চরিত্রগুলির মতোই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন দ্বন্দ্বময়, জটিল, অথচ কোমল।

ছোট থেকে দেখা ঘর ভর্তি রবীন্দ্র রচনাবলী, শিশুবেলায় মায়ের থেকে শোনা “গীতবিতান”এর গান কবিতার রূপে, “সঞ্চয়িতা” কবিতাগুলি মনের মধ্যে প্রভাব ফেলেছিল। বইয়ে ছবি থাকা দাঁড়ি ওয়ালা লোকটা আসলে কে, তখন জানা ছিল না। প্রথম “সহজপাঠ” বইয়ের হাত ধরে রবীন্দ্রনাথকে তাঁর প্রথম চেনা ও অজানার পরিধি বৃদ্ধি করা। সময়ের স্রোত বয়ে নিয়ে যায় অনেক দূরে, আনন্দে- ভালোবাসায়- দুঃখে – প্রেমে – যন্ত্রণায় রবীন্দ্রনাথকে সর্বক্ষণের সঙ্গী মনে হতো।

চোখেরবালি চলচ্চিত্রে আশালতা ও বিনোদিনী

চোখের বালি” সিনেমায় বিনোদিনীর চরিত্র নির্মাণে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস যেমন অনুপ্রেরণা, তেমনি তার ভেতরে ছিল তাঁর নিজস্ব ভাষ্য—নারীর কামনা, স্বাধীনতা, ও অস্বীকৃত শক্তির এক দৃঢ় রূপ। কাছে না পেয়েও যে ভালোবাসা যায় তা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন।

তেমনি “চিত্রাঙ্গদা” চলচ্চিত্রটি ছিল রবীন্দ্রনাথের নাট্যনাটক অবলম্বনে নির্মিত, কিন্তু এখানেই ঋতুপর্ণ তাঁকে নতুন করে রূপ দিলেন। এখানে চিত্রাঙ্গদা কেবল পুরাণের রাজকন্যা নন—তিনি হলেন এক শিল্পীর আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের চূড়ান্ত প্রতীক। সিনেমার এক মুহূর্তে ঋতুপর্ণ নিজে বলেন:
“আমি চেয়েছিলাম, তুমি আমায় যেমন খুশি, তেমন করে গ্রহণ করো।”
এই মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের সেই চিরন্তন পংক্তি ভেসে ওঠে:

“জীবনের কাছে চাইনি সুখ,
শুধু চাইনি ভয়হীন এক অন্তর।”

ঋতুপর্ণের ছবিতে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব কখনো কাব্যিক, কখনো ভাবনাগত। তাঁর অনেক ছবিতে সরাসরি রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহৃত হয়েছে, আবার কখনো তা এসেছে এক ছায়ার মতো, চরিত্রের ভাবনায়।

নৌকাডুবি ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত সিনেমা

নৌকাডুবি ছবিতে যেমন ঋতুপর্ণ সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলেন, আবার সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চরিত্রগুলিকে তিনি করে তোলেন আরো জীবন্ত, মানবিক, জটিল।

রেইনকোট (গল্পের মূল ভাবনা রবীন্দ্রনাথের “পোস্টমাস্টার”-এর ছায়ায়) – এখানে সময় ও দূরত্বের মধ্যে আটকে থাকা দুটি চরিত্রের একদিনের সাক্ষাৎ, মৃদু অনুভবে গাঁথা রবীন্দ্র ভাবনার আধুনিক প্রতিরূপ।

তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ মানে ছিল প্রশ্ন করার সাহস, অনুভবের গভীরতা, এবং বহুমাত্রিক পরিচয়কে মেনে নেওয়ার শক্তি। ঋতুপর্ণ ঘোষ নিজেকে সমাজের এক প্রান্তিক মানুষ হিসেবে বারবার খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর লিঙ্গ পরিচয়, পোশাক, ভাষা—সবকিছুই ছিল সাধারণের চোখে “ভিন্ন”। অনেকেই তাঁর কাজকে ‘সামাজিকভাবে অস্বস্তিকর’ বা ‘অত্যাধিক ব্যক্তিগত’ বলে মনে করেছে। তিনি ছিলেন আলোচিত, আবার উপেক্ষিতও। কিন্তু এ উপেক্ষা তাঁর নির্মাণকে থামাতে পারেনি। বরং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শিখিয়েছিলেন—নিজের অভ্যন্তরীণ সত্যকে না লুকিয়ে প্রকাশ করাই একমাত্র মুক্তি।

ঋতুর চোখে রবীন্দ্রনাথের চরিত্রগুলি

“তুমি নিজেরে করো জয়”—এই পংক্তির মতোই ঋতুপর্ণ নিজের কাজকে নিজের অস্তিত্বের জয় হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন। যখন বাংলা সিনেমায় বাণিজ্যিক ঝোঁক বাড়ছিল, ঋতুপর্ণ রবীন্দ্রনাথের ভেতরের অশ্রুত স্বরকে নিজের মাধ্যমে শ্রবণযোগ্য করে তুলেছিলেন। তিনি কোনো মতবাদের চলচ্চিত্র বানাননি—তাঁর চলচ্চিত্র ছিল অনুভবের, আত্মসমীক্ষার, আর কবিতার মতো ধীরে ধীরে খুলে যাওয়া এক শিল্পরূপ।

ঋতুপর্ণের এই সাহস, যা রবীন্দ্রনাথের দর্শন থেকে লালিত, আজকের প্রজন্মকে সাহস জোগায় নিজের পরিচয় নিয়ে বাঁচতে। সমাজ তাঁকে তখন স্বীকৃতি দেয়নি, কিন্তু আজ তাঁর সৃষ্টি আমাদের হৃদয়ে বেঁচে আছে। তাঁর নির্মিত ছবিগুলি যেন জীবনের সেই ‘আলোকপাত’—যা অন্ধকারে থেকেও আলোর পথ দেখায়। রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ঋতুপর্ণ ঘোষের ভেতরে এক নীরব, অথচ বিশাল আন্দোলন তৈরি করেছিল। তাঁর জীবনজুড়ে ছিল রবীন্দ্রনাথের মতোই এক আত্মপ্রশ্ন: “আমি কে?” আর সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই তিনি গড়ে তুলেছেন এক সিনেমার আত্মজীবনী। এ এক দ্বৈত সত্তার সেতুবন্ধন—যেখানে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কলমে জেগে উঠেছেন আবার, আর ঋতুপর্ণ নিজের নির্মাণে তাঁর উত্তরাধিকার।

তথ্যসূত্র:

অদিতি সিংহ
অদিতি সিংহ
সম্পাদনা, সাংবাদিকতা, এবং সৃজনশীল লেখায় প্রায়োগিক অভিজ্ঞতা নিয়ে অদিতি এক উদীয়মান সাহিত্যিক কণ্ঠ। বাংলা সাহিত্যের প্রতি অগাধ ভালোবাসা এবং সুগভীর প্রতিভার অধিকারী এক তরুণ লেখিকা। বাংলা সাহিত্যে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করে, নিয়মিত বিভিন্ন পত্রিকা, ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল এবং সংকলনে তার লেখা প্রকাশ হয়েছে। তার লেখা একক বই এবং সম্পাদিত সংকলন কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় প্রকাশ পেয়েছে, তার “মৃত্যু মিছিল” বইটি পাঠকমহলে বেশ জনপ্রিয়। তার সৃষ্টিশীলতার প্রসার ঘটেছে আকাশবাণী এবং ফ্রেন্ডস এফএম-এ, যেখানে তার লেখা সম্প্রচারিত হয়েছে। অদিতির মতে, "বইয়ের থেকে পরম বন্ধু আর কেউ হয় না," এবং এই বিশ্বাস তাকে সাহিত্য জগতে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নিয়ে চলেছে। বর্তমানে তিনি “বিশ্ব বাংলা হাব” -এ লেখক পদে কর্মরত।

প্রাসঙ্গিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here
Captcha verification failed!
CAPTCHA user score failed. Please contact us!

সাথে থাকুন

110FansLike
105FollowersFollow
190SubscribersSubscribe
- বিজ্ঞাপন -spot_img

বাংলা ক্যালেন্ডার

সাম্প্রতিক