“সমতাবিধান” যার অর্থ সমান আধিকার যাপন করা। সমানতা সকলের একমাত্র নৈতিক অধিকার। শিশু জন্মানোর পর তার লিঙ্গ নির্ধারণ করে দেয় সমাজ। সমাজও যে অনেক সময় ভুল প্রমাণিত হয় তার বিচার কে করবে? এখানে আপনি কিংবা আমি বলার কেউ না, প্রাচীন পৌরাণিক কথা মেনেই প্রতিদিনের জীবন চলে।
এই সমাজে চোখে পড়ে এক শ্রেণীর মানুষ, শারীরিক বা মানবিক গঠনে তারা সকলের থেকে ভিন্ন। ছোটবেলায় পড়া থাকা ক্লীবলিঙ্গ বা তৃতীয় লিঙ্গ এর সঙ্গে তুলনা করে থাকি তাদের। অগত্যা অদের ‘বস্তু’ হিসেবেই ধরা হয়।
আসলে তৃতীয় লিঙ্গ হল একটি মতবাদ। যাতে এমন ব্যক্তিদের শ্রেণীভুক্ত করা হয়, যারা নিজে অথবা সমাজের দ্বারা পুরুষ বা নারী কোনটাই হিসেবে স্বীকৃত নয় এটি পাশাপাশি কিছু সমাজের একটি সামাজিক শ্রেণীকে বোঝায়, যে সমাজগুলো তিন বা ততোধিক লিঙ্গের শ্রেণীবিভাগ করেন। তৃতীয় পরিভাষাটি সাধারণত ‘অন্য’ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়; কিছু নৃতত্ত্ববিদগণ এবং সমাজবিজ্ঞানীগণ চতুর্থ এবং ‘কিছু’ লিঙ্গের বর্ণনা দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে এর ছোঁয়া পাওয়া যায়।

ভারতীয় সংস্কৃতির সম্পাদনায়; হিন্দু দেবতা শিবকে প্রায়ই ‘অর্ধনারীশ্বর’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যার দ্বৈত পুরুষ ও মহিলা প্রতিকৃতি আছে। সাধারণত, অর্ধনারীশ্বরের ডান দিক পুরুষ এবং বাম পাশ মহিলা। তৃতীয় লিঙ্গ ধারনাটি ভারতের তিনটি প্রাচীন আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের সমস্ত গ্রন্থে পাওয়া যায় হিন্দুধর্ম, জৈনধর্ম এবং বৌদ্ধধর্ম – এর থেকে ধারণা করা যেতে পারে যে বৈদিক সংস্কৃতি তিনটি লিঙ্গকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বেদ (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০-৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এর মতে একজন ব্যক্তির প্রকৃতি বা প্রকার অনুযায়ী, তিনটি শ্রেণিতে এক ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। তারা কাম সূত্র (চতুর্থ শতাব্দী খ্রিষ্টাব্দ) নামেও পরিচিত এবং অন্যত্র পুমার-প্রকৃতি (পুরুষ প্রকৃতি), স্ত্রী-প্রকৃতি (নারী-প্রকৃতি) এবং তৃতীয় প্রকৃতি নামেও এটি উল্লেখ করা হয়েছে। পাঠ্যসূচিতে বলা হয়েছে যে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলি প্রাক্তন ভারতে সুপরিচিত এবং পুরুষ দেহবিশিষ্ট বা মহিলা দেহবিশিষ্ট মানুষ। আন্তযৌনাঙ্গ এর অন্তর্ভুক্ত এবং যেগুলি প্রায়ই শৈশব থেকে স্বীকৃত হয়ে থাকে।
প্রাচীন হিন্দু আইন, বেদ, পুরাণ, ভাষাতত্ত্ব এবং জ্যোতিষশাস্ত্রে একটি তৃতীয় লিঙ্গ আলোচনা করা হয়। ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ২০০ খ্রিষ্টাব্দ তিন লিঙ্গের জৈবিক উৎস ব্যাখ্যা করে। ভারতীয় ভাষাবিদ পতঞ্জলির কাজ সংস্কৃত ব্যাকরণ মহাভাষায় (২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বলেছেন যে, সংস্কৃতের তিনটি ব্যাকরণগত লিঙ্গ তিনটি প্রাকৃতিক লিঙ্গ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। প্রাচীনতম তামিল ব্যাকরণ টলকাপ্পিয়াম (তয় শতাব্দী) হেমফ্রেডাইটকে তৃতীয় “নিগূঢ়” লিঙ্গ হিসেবে বর্ণনা করে পুরুষের নারীর শ্রেণীবিন্যাস ছাড়াও বৈদিক জ্যোতিষশাস্ত্রে নয়টি গ্রহের তিনটি পুরুষের মধ্যে একটি; তৃতীয় লিঙ্গ বুধ, শনি এবং (বিশেষ করে) কেতুর সঙ্গে যুক্ত। পুরাণে, তিন ধরনের দেবদেবীর গান ও নাচ উল্লেখ আছে: অপ্সরা (মহিলা), গান্ধার (পুরুষ) এবং কন্নড় (উভয় লিঙ্গ)।
দুটি মহা সংস্কৃত মহাকাব্য রামায়ণ এবং মহাভারত প্রাচীন ভারতীয় সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের অস্তিত্বকে নির্দেশ করে। রামায়ণের কয়েকটি সংস্করণ এই গল্পের একটি অংশে বর্ণিত আছে, রামায়ণের রাম বনভূমিতে নির্বাসনে নেতৃত্ব দেন। সেখানে মাঝ পথে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন যে, তার বাড়ি অযোধ্যায় অধিকাংশ লোক তালে অনুসরণ করেছিল। তিনি তাদের বলেছিলেন, “পুরুষ ও নারীরা, পিছনে ফিরো”, এবং সেই সঙ্গে, যারা ‘পুরুষ ও নারী’ ছিল না, তারা জানতো না কি করতে হবে তাই তারা সেখানেই থেকে গেল মিহাভারতে শিখণ্ডী বলে একটি তৃতীয় লিঙ্গের চরিত্র বর্তমান। কিনি খাজা এপদের কন্যা ছিলেন। রাজা ধ্রুপদ তাঁকে পুত্রের মত করে বড় করে তলেছিলেন, যাতে পরবর্তী কালে সে কৌরবদের হারাতে পারে যুদ্ধে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ভীষ্মকে পরাজিত করেছিলেন শিখন্ডী। এমনকি শিখণ্ডিনির সঙ্গে রাজা ধ্রুপদ একজন মহিলার বিবাহ দেন। যদিও পরবর্তীকালে শিখণ্ডী উর্জলিঙ্গ হিসেবেই স্বীকৃতি লাভ করেন। অজ্ঞাতবাসে থাকা কালীন অর্জুনের বৃহন্নলা বেশের কথা তো সকলের জানা।
মেসোপটেমিয়ার পৌরাণিক কাহিনীতে মানবতার, প্রাথমিক লিখিত রেকর্ডগুলির মধ্যে এমন ধরনের রেফারেন্স রয়েছে যা পুরুষও নয় এবং নারীও নয়। ভূমধ্য সংস্কৃতিতে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের কাছাকাছি সময়ে লিখিত প্লেটো’র সিম্পোজিয়ামে অরিস্টোফেনসের সঙ্গে জড়িত পৌরাণিকতা সম্পর্কিত তিনটি লিঙ্গের বর্ণনা পাওয়া যায়। আরো বিভিন্ন দেশ যেমন মিশর, আমেরিকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বর্তমান সমাজে ‘তৃতীয় লিঙ্গের’ শ্রেণীর মানুষদের সঠিক সম্মান বা স্বীকৃতি মেলে না। সমাজ তাদের স্বাধীনতার অধিকার পর্যন্ত দেয়। প্রাচীনকালের বর্ণিত পুরান, বেদের কাহিনীগুলিতে তাদের সমান অধিকারের কথা উল্লেখ ছিল, তবে বর্তমান সমাজ এটা মানতে নারাজ। তাদের ন্যূনতম অধিকারের জন্য অনেকেই এই বিষয়ে আলোচনা ও মন্তব্য করেছেন। বিভিন্ন ভাষাবিদ, সমাজতত্ত্ববিদ, সাহিত্যিক এই বিষয়ের উপর নানান বই লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যে এই বিষয়ের ওপর গবেষণা করা যায়। ড. মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় একজন অধ্যক্ষ। তিনি ভারতের প্রথম রূপান্তরকামী অধ্যক্ষ। বাংলায় পিএইচডি করেন, তিনি পশ্চিমবঙ্গের ট্রান্সজেন্ডার ওয়েলফেয়ার বোর্ডের ভাইস চেয়ারপার্সনও হন। তিনি নিজের জায়গাটা সমাজ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এক শ্রেষ্ঠ রূপান্তর কামী সৃষ্টি হল তারাশঙ্করের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ উপন্যাসের নসুবালা। সে বিয়ে করেছিল, কিন্তু ঘর করতে পারে নি।বৌ তাড়িয়ে দিয়েছিল।করালীর সংসারে নসুবালা তার বউয়ের ননদ হয়ে থাকতে চেয়েছিল। প্রকৃতিতে পুরুষ নসুরামের জীবন হয়ে গেল নারীর সাজসজ্জায়, নারী কোমলতায়-ব্যবহারে নসুবালা। সে চরিত্রে যথার্থ মানবিক।
সমাজ কোন বিষয়টা মানবে, আর বিষয়টা মানবে না; সেটা সম্পূর্ণ সমাজের উপর নির্ভরশীল, তরও যে মানুষচালো জন্মেছে, অন্তত্য পরিবার থেকে তাদের স্বীকৃতি পাওড়া অধিকার কাম্য। অবলীলায়- অবচেতনে – অযত্নে – অকারণে যেন আর কোনো জীবন শেষ না হয়।
তথ্যসূত্র:
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: চিত্রাঙ্গদা
২. স্বপ্নময় চক্রবর্তী: “হলদে গোলাপ”
৩. মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়: “অন্তহীন অন্তরিন প্রোষিতভর্তৃকা”
৪. ঋতুপর্ণ ঘোষ: “ফাস্ট পার্সন (১, ২ খন্ড)”
৫. মল্লিকা সেনগুপ্ত: “স্ত্রীলিঙ্গ নির্মাণ”
৬ . তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়: “হাঁসুলী বাঁকের উপকথা”