সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক রসালো উপাখ্যান
বাংলা রসনায় আমের স্থান বরাবরই রাজকীয়। কেবল ফল হিসেবে নয়, আম বাঙালির চেতনায়, সংস্কৃতিতে ও সাহিত্যে এক গভীর স্থান অধিকার করে আছে। আর এই আম যখন ঠাঁই পেয়েছে বাংলার নবজাগরণের প্রাণকেন্দ্র জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে, তখন তা হয়ে উঠেছে কেবল একটি খাদ্য নয়—একটি সাহিত্যিক অনুষঙ্গ, একটি সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি।
আমকে কেন্দ্র করে ঠাকুরবাড়ির গ্রীষ্মকালীন জীবনধারা, রান্নাঘরের কর্মব্যস্ততা, এবং সাহিত্যিক রচনায় তার প্রতিফলন—এসব মিলে ‘আম’ এক বৈষ্ণবিক রসের প্রতীক হয়ে উঠেছে, যে রস শরীরে যেমন প্রশান্তি আনে, তেমনি মনে সৃষ্টি করে স্মৃতি, সংবেদন ও সাহিত্য।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে গ্রীষ্মকাল মানেই আমের আধিপত্য। পূর্ববঙ্গে—বিশেষ করে যশোর, রাজশাহী ও কুষ্টিয়া থেকে আম আসত ঠাকুরবাড়িতে। হিমসাগর, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ফজলি—এসব জাতের আম বাড়ির ছেলেমেয়ে থেকে বড়দের মন জয় করত। রান্নাঘরে তৈরি হতো—

- আমসত্ত্ব – পাকা আমের নির্যাস দিয়ে শুকিয়ে বানানো মিষ্টান্ন।
- আম-ডাল – কাঁচা আম দিয়ে রান্না করা মুগ বা মসুর ডাল।
- আম-পোলাও – হালকা মিষ্টি ও সুগন্ধি, আমের রসে ভেজানো চাল।
- আম-দই – ঘন দইয়ের সঙ্গে মিশানো কাটা পাকা আম, ঠান্ডা ও তৃপ্তিকর।
- আমের চাটনি – পাকা বা আধা-পাকা আম, পাঁচফোড়ন ও গুড় দিয়ে তৈরি।
রান্নাঘরের নারী সমাজের ব্যস্ততা ও আম নিয়ে তাঁদের প্রতিযোগিতা—কে কেমন আমসত্ত্ব বানাতে পারে, কার আমচাটনি বেশি প্রশংসিত হবে—এসব ঠাকুরবাড়ির জীবনের এক নিটোল ছবি আঁকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিজীবনে এবং সাহিত্যে আম এক ঘনিষ্ঠ সঙ্গী। তিনি শিলাইদহে থাকাকালীন চিঠিতে বারবার আমের কথা লিখেছেন, যেমন তাঁর একটি চিঠিতে তিনি বলেন:
“এখানে গাছের নিচে বসে কাটালাম এক বিকেল। সামনে ঝোপের আড়ালে দোল খায় পাকা আমের গন্ধ।” (সূত্র: ‘ছিন্নপত্রাবলী‘, বিশ্বভারতী প্রকাশন)
তিনি খাদ্যরসিক না হলেও রুচিশীল ছিলেন। কাদম্বিনী দেবীর লেখা এক চিঠিতে (রবীন্দ্রনাথকে লেখা) রয়েছে,
“আপনার জন্য আজ বাগান থেকে যে আম এনেছি, তার রস যেন সুরে বাঁধা যায়।”
‘চতুরঙ্গ‘ উপন্যাসে চরিত্রদের মধ্যে আম খাওয়ার ধীর ভাবনাতীত বর্ণনা আসে এক আধ্যাত্মিক অনুভূতি হিসেবে। এমনকি তাঁর ছোট গল্প ‘গল্পগুচ্ছ’র ‘খোকার কার্যকলাপ’–এও আম খাওয়ার প্রসঙ্গ আসে, একটি শিশু চরিত্রের মাধ্যমে।
আমের রসালতা, তার ঋতু-বিশেষতা এবং বাঙালির আবেগের সঙ্গে তার সম্পর্ক অনেক বাঙালি সাহিত্যিক তুলে ধরেছেন তাঁদের লেখায়। নিচে কয়েকজনের উল্লেখ করছি—

‘লোকরহস্য’ নামক প্রবন্ধগ্রন্থে বঙ্কিমচন্দ্র আমসত্ত্ব নিয়ে এক মন্তব্য করেন:
“বাঙালি রমণীর দুটি সৃষ্টিশীল দিক—একটি রসগোল্লা, অন্যটি আমসত্ত্ব। একটিতে প্রেম, অন্যটিতে প্রকৃতি।” তিনি আম খাওয়ার মধ্যে নারীর ঘরোয়া শিল্প ও দেশীয় গৌরবের প্রতিচ্ছবি দেখেছেন।
‘বিন্দুর ছেলে’ গল্পে এক দরিদ্র পরিবারের ছোটো ছেলেটির পাকা আম দেখে জিভে জল আসা এবং তার মায়ের লজ্জা—এই দুই আবেগ একসঙ্গে মিশে আছে। শরৎচন্দ্র সমাজের শ্রেণিভেদ এবং খাদ্যের আকাঙ্ক্ষা খুব সূক্ষ্মভাবে দেখিয়েছেন।
“ছেলেটি দৃষ্টি নিবদ্ধ করল আমের দিকে, কিন্তু হাত বাড়াল না।”
‘কবির নাম গোপাল’ গল্পে গ্রামীণ জীবনে আম গাছের ছায়ায় বসে কবির বাউলদের গানের ধারা চলে। আম গাছ সেখানে কেবল গ্রীষ্মের প্রতীক নয়, বরং নির্জনতার, সাধনার এবং ফসলের প্রতীক।
সুনীলের ‘সেই সময়’ উপন্যাসে ১৮-১৯ শতকের কলকাতা ও কাশীতে বসবাসরত বাঙালি সম্প্রদায়ের খাবার ও আমসত্ত্বের বর্ণনা আছে। ব্রাহ্ম আন্দোলনের সঙ্গে বাঙালি জীবনযাত্রার রূপান্তরে আমের গুরুত্ব রয়ে যায় অক্ষুণ্ণ।
যদিও তিনি বাংলাদেশি লেখক, তবুও বাংলা সাহিত্যের অঙ্গ। তাঁর বহু উপন্যাসে গ্রীষ্ম ও আম—এই দুই একত্রে এসেছে। যেমন ‘আমার ছেলেবেলা’ বইতে তিনি বলেন:
“আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে পাকা আমের গন্ধ শুঁকে মনে হতো, এই বুঝি স্বর্গ।”
বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন বা ঠাকুরবাড়ি থেকে ছড়িয়ে পড়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে যখন বিদেশি অতিথিরা আসতেন, তাঁদের আপ্যায়নে আমের ব্যবহার ছিল সাধারণ। বিদেশি লেখক ইউজিন পিটারসন তাঁর ভ্রমণকথায় লিখেছেন (১৯৩০):
“An old lady at Jorasanko gave me a slice of something called ‘Aamshotto’. Sweet and sublime— it was like tasting poetry.”
বাঙালি প্রবাসীরা আজও লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, টরোন্টোতে রবীন্দ্রজয়ন্তীতে আম-ভিত্তিক মেনু রাখেন—যার শুরুটা হয়েছে এই ঠাকুরবাড়ির ঐতিহ্য থেকে।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির আম শুধু একটি ফল নয়—তা হয়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক গভীর রসাত্মক প্রতীক। সাহিত্যিকরা আমের বর্ণনায় সীমাবদ্ধ থাকেননি, তাঁরা এর স্বাদে খুঁজে পেয়েছেন প্রেম, তৃষ্ণা, দারিদ্র্য, স্মৃতি, সাধনা, এবং আত্মোপলব্ধি। ‘আম’ বাঙালির চেতনায় যেমন, তেমনি তার সাহিত্যে, এক চিরকালীন ঋতুর মতোই বারবার ফিরে আসে, বারবার নতুন ব্যঞ্জনা নিয়ে।
তথ্যসূত্র
- ঠাকুরবাড়ির রান্না – পুণ্যবাণী দেবী
- ঠাকুরবাড়ির রান্নাবান্না – আশালতা দেবী
- বাঙালির খাওয়াদাওয়া – চিত্রা দেব
- রান্নার বই – প্রজ্ঞা সুন্দরী দেবী
- ঠাকুরবাড়ির রেসিপি ডায়েরি – সুনন্দা দেবী
- দ্য বেঙ্গলি ফাইভ স্পাইস ক্রনিকলস – রুমা দাসগুপ্তা
- বাংলা রান্না: দ্য বেঙ্গল কুকবুক – মিনাক্ষী দাশগুপ্ত
- ট্র্যাডিশনাল বেঙ্গলি কুইজিন – অরুণ চট্টোপাধ্যায়
- ঠাকুরবাড়ির অনুপ্রেরণায়: রান্না ও রীতির ইতিহাস
- ছবি: আরাম্ভা পত্রিকা, রোববার, শনিবারের চিঠি, আনন্দবাজার পত্রিকা