সময় কারও জন্য অপেক্ষা করে না—এই কথাটা যেন মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রগুলোর নীরব অন্তর্নিহিত রোমাঞ্চ। সময় প্রবাহমান, জীবনের গল্পগুলো অনবরত বয়ে যায়, আর তাদের মধ্যে থেকেই কিছু ‘অতি সাধারণ’ দৃশ্য, কিছু ‘ছোট’ ঘটনা, একেবারে আটপৌরে জীবনের ছায়া হয়ে তার ফ্রেমে ধরা পড়ে।
চলচ্চিত্র বা “মোশন পিকচার” শব্দটি শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে চলমান চিত্রের এক প্রবাহ, যা মূলত বিনোদনের জন্য নির্মিত। কিন্তু মৃণাল সেনের কাছে চলচ্চিত্র ছিল আত্মসন্ধানের এক তীক্ষ্ণ অস্ত্র। তাঁর ভাষায়, “I make films to expose myself first, and then the world.” অর্থাৎ, তাঁর কাছে সিনেমা ছিল আত্মসমালোচনার একটি হাতিয়ার। তিনি ছবি বানিয়েছেন কাঁধে পিস্তল রাখার মতো করে নয়, বরং আয়নার মতো করে, যেখানে প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি সংলাপ আমাদের নিজেদের দিকে তাক করিয়ে দেয়।

তিনি কখনও দর্শকদের সন্তুষ্ট করার জন্য ছবি বানাননি। বরং তাঁর ছবিগুলো এক ধরনের অস্বস্তি সৃষ্টি করে। আর ঠিক এই অস্বস্তিই তাঁর সিনেমার সত্যিকারের সৌন্দর্য।
মৃণাল সেন কখনওই দর্শককে বিনোদনের ছলনায় মাতিয়ে রাখেননি। বরং তিনি প্রশ্ন করেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন—’’আপনি যা দেখছেন তা কি আদৌ সত্যি? আপনি যে চরিত্রটাকে দোষারোপ করছেন, তার জায়গায় যদি আপনি থাকতেন?” ১৯৬৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ভুবন সোম সিনেমায় তিনি এই দ্বিধা, এই মানবিকতার দ্বন্দ্বটাকেই তুলে ধরেন অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে। এক ‘কঠোর’ সরকারি আধিকারিক কীভাবে এক গ্রামীণ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তার ভিতরকার সংবেদনশীলতাকে আবিষ্কার করেন—তা যেন ‘অতি সাধারণ’ গল্পের ভেতর অতি অসাধারণ প্রভাব।
মৃণাল সেনের সিনেমা ছিল রাজনৈতিক, কিন্তু প্রপাগান্ডা নয়। তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তীক্ষ্ণ, কিন্তু কখনও পক্ষপাতদুষ্ট নয়। ইন্টারভিউ, ক্যালকাটা ৭১, পদাতিক, কিংবা একদিন প্রত্যেকদিন—সবগুলো ছবিতেই দেখা যায় নাগরিক জীবনের এক চরম বাস্তবতা, যেখানে মানুষের মুখোশ উন্মোচিত হয়, বুর্জোয়া আদর্শের আস্তরণ খসে পড়ে।

চলচ্চিত্র তাঁর কাছে কেবল ‘মোশন পিকচার’ নয়; সেটি ছিল একটি মাধ্যম, যার মাধ্যমে সমাজ, শ্রেণীসংঘাত, রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বগুলোকে দৃশ্যমান করা যায়। তাঁর সিনেমা দেখে কেউ আনন্দে হাততালি দেয় না, বরং এক অস্বস্তি নিয়ে হল ছাড়ে। কারণ তিনি চেয়েছেন দর্শক ভাবুক হোক, প্রশ্ন করুক।
আজকের সময়ে, যেখানে গল্প মানেই যেন এক ধরনের ‘উৎপাদন’, যেখানে প্লট তৈরি হয় বাজারের চাহিদা অনুসারে—সেখানে মৃণাল সেনের গল্প এক অনুপম ব্যতিক্রম। অনেক নতুন লেখক-লেখিকা উঠে আসছেন, অনেকেই সিনেমার জন্য গল্প লিখছেন, কিন্তু তাঁদের অধিকাংশ লেখা যেন কেবল একধরনের ‘আমদানি পণ্য’। জীবনের গভীরতা, চরিত্রের আত্মসংঘাত, বাস্তবের আলোছায়া সেখানে খুব কমই উপস্থিত।
একটা সময় মানুষ খবরের কাগজ পড়ে সমাজ বুঝত, বিশ্লেষণ করত; আজ তা সোশ্যাল মিডিয়ার স্ক্রল-ভিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্রুত রিল, দ্রুত অনুভব, দ্রুত ভুলে যাওয়া—এই সংস্কৃতিতে মৃণাল সেন যেন এক নীরব প্রতিবাদ। তিনি মনে করিয়ে দেন, গল্প মানে সময়ের সাক্ষ্য বহন, এক ধরনের ইতিহাস, যা আমরা আজ দেখছি, ভাবছি, এবং কোন পথে হাঁটছি।
মৃণাল সেন ছিলেন এবং আছেন—তাঁর সিনেমার দৃশ্য, সংলাপ, নিস্তব্ধতা, এবং অস্বস্তি আমাদের চিন্তা করতে শেখায়। তিনি কখনও নায়ক তৈরি করেননি, বরং প্রশ্ন তৈরি করেছেন। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যখন আমরা শুধুমাত্র দৃষ্টির জন্য সিনেমা দেখি, তখন মৃণাল সেনের কাজ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সিনেমা আসলে কানে শোনা, মনে অনুভব করা, এবং মনের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করার শিল্প।
তথ্যসূত্র
- চার্লি চ্যাপলিন: মৃণাল সেন
- তৃতীয় ভুবন: মৃণাল সেন
- আমি ও আমার সিনেমা: মৃণাল সেন
- অনেক মুখ অনেক মুহূর্ত: মৃণাল সেন
- আমি এবং চলচ্চিত্র: মৃণাল সেন
- প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিরোধের আগুন: মৃণাল সেন
- আমার চ্যাপলিন: মৃণাল সেন
- মৃণাল সেনের ফিল্মযাত্রা: শিলাদিত্য সেন
সম্পাদনা, সাংবাদিকতা, এবং সৃজনশীল লেখায় প্রায়োগিক অভিজ্ঞতা নিয়ে অদিতি এক উদীয়মান সাহিত্যিক কণ্ঠ। বাংলা সাহিত্যের প্রতি অগাধ ভালোবাসা এবং সুগভীর প্রতিভার অধিকারী এক তরুণ লেখিকা। বাংলা সাহিত্যে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করে, নিয়মিত বিভিন্ন পত্রিকা, ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল এবং সংকলনে তার লেখা প্রকাশ হয়েছে। তার লেখা একক বই এবং সম্পাদিত সংকলন কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় প্রকাশ পেয়েছে, তার “মৃত্যু মিছিল” বইটি পাঠকমহলে বেশ জনপ্রিয়। তার সৃষ্টিশীলতার প্রসার ঘটেছে আকাশবাণী এবং ফ্রেন্ডস এফএম-এ, যেখানে তার লেখা সম্প্রচারিত হয়েছে। অদিতির মতে, "বইয়ের থেকে পরম বন্ধু আর কেউ হয় না," এবং এই বিশ্বাস তাকে সাহিত্য জগতে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নিয়ে চলেছে। বর্তমানে তিনি “বিশ্ব বাংলা হাব” -এ লেখক পদে কর্মরত।