নাট্যজগতে “রক্তকরবী” এক ব্যতিক্রমী স্থান অধিকার করে রেখেছে। প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে, অথচ এই নাটকের মূল সুর আজও আমাদের চেতনাকে আলোড়িত করে। ‘রক্তকরবী’ শুধু একটি নাটক নয়, এটি এক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতীকী প্রতিবাদ, যেখানে মূল চরিত্র নন্দিনী হয়ে উঠেছে অন্ধকার যক্ষপুরীর মধ্যে আলো, প্রেম, প্রশ্ন আর বিদ্রোহের প্রতিমা। শতবর্ষ পরে ফিরে তাকালে আজও নন্দিনীর ছায়া অনুভব করা যায় – ঠিক যেন “তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম”-র মতো।
রবীন্দ্রনাথ যখন লেখেন, “তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম,” তখন তিনি শুধু একজন প্রিয়জনের আবেগময় উপস্থিতির কথা বলেন না, তিনি এক অদৃশ্য কিন্তু গভীরভাবে কার্যকর আত্মিক সম্পর্কের কথাও বলেন।
এই নীরবতা, এই হৃদয়ে মিশে থাকা শক্তি – এটাই নন্দিনী চরিত্রের মর্মস্থল। নাটকে নন্দিনী একটি বহমান চেতনার প্রতীক – সে কথা বলে, ভালোবাসে, প্রতিবাদ করে, কিন্তু সেই চেতনাটা শুধু সংলাপে নয়, তার উপস্থিতিতে, তার প্রশ্নে, তার প্রেমে, এবং তার নির্ভীকতা ও সত্য অন্বেষণে।
নন্দিনী রাজা থেকে শুরু করে শ্রমিক, বিপ্লবী, খনি-মজুর – সকলের মনে আলোড়ন তোলে। রাজা, যিনি নিজেকে আড়ালে লুকিয়ে রেখেছেন স্বার্থপরতার ও ভয়ের অন্তরালে, তিনিও অবচেতনে নন্দিনীর আকর্ষণে ধরা দেন। তাঁর একাকীত্বে, তাঁর দ্বিধা-দ্বন্দ্বে, নন্দিনীর উপস্থিতি হয়ে ওঠে মুক্তির সম্ভাবনা।

নন্দিনী এমন এক শক্তি, যাকে সকলেই চায় নিজের করে পেতে। কিন্তু নন্দিনী “নিজের” হয় না কারোর, সে শুধু আলোকবর্তিকা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সকলের ভেতর। সে যেমন প্রেম দেয় রণকে, তেমনই সে জাগ্রত করে প্রতিবাদের ইচ্ছা গোবিন্দর মধ্যে।
‘রক্তকরবী’-তে নন্দিনীকে দেখা যায় মানবতার, প্রেমের, এবং প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে। নাটকের যক্ষপুরী হলো এক শোষণের, নিষ্ঠুরতার এবং আত্মগোপনের রাজনীতি। সেই পৃথিবীতে নন্দিনীর আবির্ভাব যেন এক বিক্ষোভ-ধ্বনি।
তিনি নারী – অথচ পরাধীন নয়। তিনি প্রেমিকা – কিন্তু বিক্রীত নয়। তিনি সরল – কিন্তু নিরীহ নয়।
তাঁর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ গড়ে তুলেছেন এক নতুন যুগের চেতনা, যেখানে নারী শুধুই প্রেমপ্রার্থিনী নয়, সত্যের দাবিদার ও সংগ্রামী চেতনার বাহক। যক্ষপুরীর রাজার মতো এক নিঃশব্দ, গোপনীয়, ছায়াময় চরিত্রের ভেতরে নন্দিনী অনুপ্রবেশ করে আলোক ও বিবেকের ঝাঁপটা নিয়ে।
তিনি বারবার প্রশ্ন করেন, উত্তরের অপেক্ষা করেন না। তাঁর স্পষ্টভাষীতা, তাঁর সরলতা, তাঁর সাহস – সব মিলিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন বিপ্লবের রক্তকরবী, এক রক্তিম ফুল যা ফুটে ওঠে অন্ধকারের মধ্যেও।
“তুমি রবে নীরবে”
এই গানটির মূল সুর নিঃশব্দ ভালোবাসা ও অনুপ্রবেশ। নন্দিনীকে আর যাই হোক, ভোলা যায় না। যক্ষপুরীর রাজা তাকে জয় করতে চাইলেও বুঝতে পারেন, তিনি নন্দিনীকে ধারণ করতে পারলেন না, কিন্তু নন্দিনী তাকে পলটে দিলেন অচিরেই।
নন্দিনী হারিয়ে যায় না, বরং প্রতিটি চরিত্রের ভিতর একটি নীরব আলো হয়ে জেগে থাকে। সে যেমন প্রেম দেয়, তেমনি সত্য দাবি করে। সে যেমন লাজুক, তেমনি স্পষ্টভাষী। সে যেমন কোমল, তেমনি লড়াকু।
এই দ্বৈততাই “তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম” -র সবচেয়ে নিখুঁত বাস্তবায়ন। নন্দিনী দৃশ্যত হারিয়ে গেলেও, প্রত্যেক চরিত্রের বিবেকের ঘরে তার ছায়া পড়ে থাকে। এই নাটক একটি নতুন সময়ের মননচর্চা ও প্রশ্নচিহ্ন। আজকের পৃথিবীতে যেখানে শোষণ, রাজনীতি, মুনাফা ও গোপনীয়তার রাজত্ব, সেখানে “রক্তকরবী” যেন এক চিরকালীন মানবিক এবং রাজনৈতিক মানদণ্ড।
নন্দিনী আজকের যুগেও আমাদের কাছে সেই বিপ্লবী প্রেম, সত্যের আহ্বান, নারীর সম্মান, এবং মানবতার আকুলতার প্রতীক। যক্ষপুরী হয়তো বদলেছে – কিন্তু তার আড়ালে থাকা রাজা আজও সক্রিয়। তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্য আজও দরকার নন্দিনীর মতো এক প্রতীকী আলো।
শত বছর পরেও “রক্তকরবী” যেন এক জাগ্রত আত্মার অনুরণন। নন্দিনী আজও আমাদের হৃদয়ে নীরবে রয়ে গেছেন – প্রেমের মতো, প্রতিবাদের মতো, সত্যের মতো। তিনি আমাদের নৈঃশব্দে প্রশ্ন করেন, আমাদের আঁধারে আলো জ্বালাতে চান।

ঠিক সেই জন্যই আজও তাঁর জন্য আমরা বলতে পারি—
“তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম”।
তথ্যসূত্র:
- রক্তকরবী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- রঙ্গচিত্র – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- চিঠিপত্র (খণ্ড ২, ৩) – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- জীবনস্মৃতি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- রবীন্দ্রনাথের নাট্যভাবনা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র (খণ্ড ২, ৩) – সম্পাদক: প্রমথনাথ বিশী
- “রক্তকরবী: সমাজচিন্তা ও রূপক” – ড. শান্তিময় রায়
- “রক্তকরবী ও আধুনিকতা” – গৌতম নস্কর
- রবিঠাকুরের জীবনে নারী
- ছবি: আরাম্ভা পত্রিকা, রোববার, শনিবারের চিঠি, আনন্দবাজার পত্রিকা